বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের ইংরেজি নববর্ষটা একটু ব্যতিক্রম। কেননা এবারের নববর্ষের মাত্র একদিন আগে ৩০ ডিসেম্বর আমাদের দেশে বহু কাক্সিক্ষত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই নববর্ষ আলাদা গুরুত্ব বহন করে। বর্ষ পরিক্রমায় পুরনোকে বিদায় দিয়ে নতুনের আগমন ঘটে প্রাকৃতিক নিয়মে। গ্রেগরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে গোটা দুনিয়ায় এ দিনটি পালিত হয় নববর্ষ হিসেবে। প্রতিটি জাতির জীবনে নববর্ষ বিশেষ তাৎপর্যের দাবি রাখে। ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীরা যে সনকে ইংরেজি সন বলে সম্বোধন করে থাকে প্রকৃতপক্ষে তা গ্রেগরিয়ান সন। পলাশী যুদ্ধোত্তর ব্রিটিশ বেনিয়ারা তাদের সুবিধার্থে আমাদের এই উপমহাদেশে যে ক্যালেন্ডার বিলেত থেকে নিয়ে আসে তা এই অঞ্চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার নামেই পরিচিতি লাভ করে।
একটি জাতির সংস্কৃতিতে সেই জাতির নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা, রুচিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, আশা-আকাক্সক্ষা, ভাষা ইত্যাদির সামগ্রিক পরিচয় বহন করে এবং তা বিশ্ব দরবারে সেই জাতির আত্মপরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করে। মূলত সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি। সংস্কৃতির বহুবিধ উপাদানের মধ্যে নববর্ষ অন্যতম। আমাদের দেশে প্রতি বছর ৩টি নববর্ষের আগমন ঘটে। পয়লা বৈশাখে আবির্ভূত হয় বাংলা নববর্ষ, মুহররমের ১ তারিখে আবির্ভূত হয় হিজরি নববর্ষ এবং ১ জানুয়ারি পালিত হয় ইংরেজি নববর্ষ।
আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-নগরে বাংলা নববর্ষে যে আনন্দ-উল্লাসে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, খুশির আমেজে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বাংলাদেশের মানুষ; ইংরেজি নববর্ষে কিন্তু শহরের বিশেষ কিছু মহল ছাড়া ব্যাপকাকারে কোথাও তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করে না। তবুও আমরা ইংরেজি নববর্ষকে আসতে দেখি নিছক গতানুগতিক অনুভবে। তবুও প্রতি বছর আমাদের দ্বারপ্রান্তে ইংরেজি নববর্ষ আসে।
ইংরেজি ক্যালেন্ডার যেহেতু আমাদের কাজকর্মের তারিখ নির্ধারণে, হিসেব-নিকেশ সংরক্ষণে, আন্তর্জাতিক তথ্য আদান-প্রদান ও সম্পর্ক স্থাপনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তাই এতে যতই ঔপনিবেশিক গন্ধ থাকুক না কেন, যতই বিজাতীয় বৈশিষ্ট্য থাকুক না কেন আমরা এর থেকে মুক্ত হতে পারছি না এ কারণে বোধ করি যে, আমরা স্বকীয় সত্তা সজাগ হওয়ার চেতনার কথা বললেও, নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমুন্নত করার কথা বললেও তা যেন অবস্থার দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে মনে হয় ওটা যেন গ্রুফে কথার কথা।
মধ্যযুগ থেকে অদ্যাবধি এ দিনটি যিশু খ্রিস্টের খত্না দেয়ার দিনের সাথে মিলিয়ে উদযাপন করা হয়। পৃথিবীর সব দেশে জানুয়ারির প্রথম দিন উৎসবে উৎসবে মুখরিত থাকে। এই দিনকে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা সৌভাগ্যের দিন বলে মনে করে। এ জন্য ভালো খাওয়া, ভালো পোশাক পরা ইত্যাদি এ সমাজে প্রচলিত আছে।
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা বিভিন্ন যুগে এর পরিমার্জনের তথ্য লাভ করি। ইংরেজি সনটা আসলে একটা সৌর সন। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, মিসরীয় প্রাচীন সভ্যতা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সৌর সনের উদ্ভব ঘটায়। মিসরীয় ক্যালেন্ডার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ৪২৩৬ অব্দ থেকে ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার ব্যবহার শুরু হয়। মিসরীয়দের থেকে গ্রিকরা ক্যালেন্ডার ব্যবহারের সূত্রপাত ঘটায়। রোমানরা তাদের প্রথম ক্যালেন্ডার লাভ করে গ্রিকদের কাছ থেকে।
রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজার মিসরীয় ক্যালেন্ডার চালু করেন। জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত ক্যালেন্ডার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। মিসরীয় ক্যালেন্ডারে সৌরবর্ষ ছিল ৩৬৫ দিনে। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরামর্শে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই আমাদের দেশে ইংরেজি ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। এই ক্যালেন্ডারের সনের শেষে সংক্ষেপে যে ‘এডি’ লেখা হয় তা ‘এনো ডোমিনি’ বা আমাদের প্রভূর বছর। এই ক্যালেন্ডার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার উচ্ছিষ্ট হিসেবে আমাদের দেশে এখনো রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে।
সে যাই হোক, নতুন বছরের নতুন দিনে এ কথা আজ আমাদের নাগরিক সমাজের কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে ধনী-গরীবের বৈষম্য বাড়লেও বাংলাদেশ আজ নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। দক্ষ ও কর্মক্ষম জনসম্পদ, কৃষিতে বিপ্লব, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য আশার বার্তা বহন করে। তবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু অর্থনৈতিক আর অবকাঠামোগত উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি অংশীদারমূলক রাজনৈতিক কাঠামোর কোনো বিকল্প নেই। আজকের রাজনীতিই ঠিক করবে আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে বারবার, কিন্তু রাজনীতির সুস্থ ধারা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। রাজনীতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক হওয়ায় ক্ষমতায় যাওয়া এবং যেকোনোভাবে ক্ষমতায় থাকাটাই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মুখ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। এ কারণে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করার জন্য ক্ষমতাসীনদের কখনোই তেমন আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। লক্ষ করার বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলে থেকে যেসব বিষয়ের পক্ষে সোচ্চার হয়, ক্ষমতায় গিয়ে সর্বাগ্রে সেগুলোই অগ্রাহ্য করে। জনগণের স্বার্থের কথা যদি বাদও দেই, তবু ক্ষমতাসীনদের নিজেদের প্রয়োজনেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিমূলক ও শক্তিশালী করা উচিত।
বর্তমান সময়ে দেখা যায়, আমাদের সমাজে ভিন্নমত ও আদর্শের প্রতি সহিষ্ণুতার অভাব ক্রমেই বাড়ছে, যা বাক, ব্যক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতা সংকুচিত করে এক দমবন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতি সৃষ্টিশীলতা বিকাশের পরিপন্থি এবং উগ্রবাদের জন্য অত্যন্ত অনুকূল; যা আমরা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষও করেছি। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাÐ, বিরোধী মত-পথের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ ইত্যাদির মূল্য শুধতে হয় অসহায় নাগরিকদেরকেই। সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সাধারণ মানুষ ভবিষ্যৎমুখী নতুন ধারার রাজনীতি দেখতে চায়।
রাজনীতি কেমন হবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে রাজনীতিবিদেরা কেমন, তার ওপর। আজকাল নতুন করে রাজনীতিতে আসতে সৎ, মেধাবী ও নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন মানুষদের আগ্রহ কম দেখা যায়। এর কারণ রাজনীতিতে সুস্থ পরিবেশের অভাব, কালো টাকা-পেশীশক্তির ওপর নির্ভরশীলতা, রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ও নীতি-আদর্শের সঙ্কট। দেশের দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চার বড় অভাব। এখানে ত্যাগী, যোগ্য নেতা-কর্মীর মূল্যায়ন যথাযথভাবে হয় না। আমাদের নিঃশ্বাস-প্রাণ ও স্পন্দনের সাথে মিশে থাকা মহান মুক্তিযুদ্ধ একদিন সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে যেমন এক সুতোয় গেঁথেছিল তেমনি এই অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো আগামী দিনগুলোতে আমাদের ঐক্যের রাজনীতির কাছে ফিরে যেতে হবে; বিভাজনের রাজনীতির যে কৌশল আমরা গ্রহণ করেছি তাতে আপামর বাঙালির লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে এ কথা প্রাজ্ঞজনরা হর হামেশাই বলে যাচ্ছেন। নতুন বছরে সরকারের কাছে, জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সরকার সেই প্রত্যাশা পূরণে শুরু থেকেই যত্নবান হবে, এটাই তারা একান্তভাবে আশা করে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন