দেশের ৫২ শতাংশ ব্যাংক বর্তমানে তথ্য নিরাপত্তার উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, সাইবার আক্রমণের মতো অতর্কিত হামলার মাধ্যমে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যদি কেউ চুরি করার চেষ্টা করে, তবে তা ঠেকানোর সক্ষমতা নেই অর্ধেকের বেশী ব্যাংকের। এই গভীর উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায়। গবেষণায় গত তিন বছরের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৫ সালে তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে অতি উচ্চ ঝুঁকিতে ১৬ শতাংশ, উচ্চ ঝুঁকিতে ৩৬ শতাংশ। ২০১২ সালে এমন ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৭০ শতাংশ। তিন বছরে এই সংখ্যা ১৮ শতাংশ কমলেও তা এখনো পুরো খাতের জন্য অনেক বেশী। ব্যাংক খাতে আইটি জনবলের অভাব এবং এর খাতের উন্নয়নে ব্যাংকের বিনিয়োগ অনীহার কথা গবেষণায় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আইটি খাতে কর্মরত মোট জনবলের মাত্র ২ শতাংশ আইটিতে কাজ করে। এখাতে সব মিলিয়ে এখন কাজ করে এক লাখ ৭৩ হাজার লোক। এর মধ্যে আইটিতে কাজ করে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার হাজার লোক। গবেষণা মতে, ৮৫ শতাংশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আইটিতে বিনিয়োগকে বাড়তি খরচ হিসেবে দেখে। যেসব ব্যাংক প্রযুক্তিতে বড় বিনিয়োগ করেছে, তারাও এখাতের খরচকে ব্যবসার মূল বিনিয়োগ মনে করে না। এ ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, উন্নততর গ্রাহক সেবা ও ব্যাংকিং কার্যক্রমে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে ৯০ শতাংশ ব্যাংকের আইটি বিষয়ক সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, আইটি জনবলের অভাব, এখাতে বিনিয়োগকে যথোচিত গুরুত্ব না দেয়া এবং আইটি বিষয়ক কোনো পরিকল্পনা না থাকা প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকগুলোকে তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে কিংবা তা বাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্যাংকের সঙ্গে গ্রাহকের সম্পর্ক ওতপ্রোত। এ সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ। গ্রাহক এই আস্থা ও বিশ্বাস পোষণ করে যে, ব্যাংকে তার তথ্য ও অর্থ নিশ্চিত ও নিরাপদ থাকবে। ব্যাংকও এই আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। ব্যাংক খাত ডিজিটালাইজড হওয়ার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধা ও সমস্যাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অসুবিধা ও সমস্যাগুলো ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটিএম সুবিধা গ্রাহকদের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত হলেও এবং তাদের সময় সাশ্রয় ও ঝামেলা মুক্ত করলেও এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় তারা বিব্রত ও উদ্বিগ্ন। তাদের পক্ষে জালিয়াতি ঠেকানো সম্ভব নয়। আবার ব্যাংকের অপারগতাও প্রমাণিত। এ ধরনের ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরাই স্বাভাবিক। কারণ, তথ্য ও অর্থের নিরাপত্তা থাকছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ টাকা চুরির ঘটনা সর্বমহলে ব্যাপক বিচলন ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকেই যদি এভাবে টাকা চুরি হয়ে যায়, টাকার নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে অন্যান্য ব্যাংকে তথ্য ও টাকার নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত না হয়ে উপায় থাকে না। এই ঘটনার পর ব্যাংক খাতে আইটি নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে। তথ্য ও অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বস্তুতপক্ষে এখন অপরিহার্য দাবিতে পরিণত হয়েছে।
ব্যাংক খাতে তথ্য ও অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা, অসমন্বিত ও অনিশ্চিত অবস্থা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। গ্রাহকরা তাদের তথ্য ও অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যায় পড়বে, এটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি ব্যাংক ব্যবসায় ধস নামবে, এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টকে আমরা বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই এ জন্য যে, প্রতিষ্ঠানটি একটি জরুরি ও গুরুত্ব বিষয়ের ওপর গবেষণা ও আলোকপাত করেছে। এতে সর্বমহলে সচেতনতা ও তাকিদ বৃদ্ধি পাবে। গবেষণায় তথ্য ও অর্থের নিরাপত্তায় কিছু সুপারিশ বা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আইটিতে দক্ষ জনবল নিয়োগ ও আইটি উন্নয়নে আরো বিনিয়োগ করার কথা। এ ছাড়া আইটি সুশাসন প্রতিষ্ঠা, তথ্যভা-ারের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, আইটি বিষয়ে নিরাপত্তা বাড়ানো এবং তথ্য আদান- প্রদানে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। আমরা আশা করতে চাই, সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেয়া হবে। ব্যাংক খাতকে কোনো বিবেচনাতেই অরক্ষিত রাখা যাবে না। হ্যাকাররা নিরাপত্তা-দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তথ্য ও অর্থ হাতিয়ে নেবে, এটা হতে পারে না। ব্যাংকগুলোতে নিñিদ্র নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন