শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নবীগণের উত্তরসূরিদের দায়িত্ব সম্পর্কে মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)

কে. এস. সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৭ এএম

আম্বিয়ায়ে কেরামের ওয়ারিশগণ ইসলামী শরীয়তের আলেম সমাজ বলে খোদ মহানবী (স.) ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কোরআনে আলেম সমাজের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। ‘বান্দাদের মধ্যে তারাই আল্লাহকে ভয় করে যারা আলেম’ (সূরা ফাতির-২৮)।
অপর আয়াতে আল্লাহ মোমিন-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দান করেছেন এবং বিভক্ত-বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন। যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না। ’ কোরআন ও হাদিসের আদর্শ শিক্ষা সকলের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তারাই আলেম সমাজ, তারাই আম্বিয়ায়ে কেরামের উত্তরাধিকারী। তারাই যদি পরস্পর দলাদলি ও কোন্দল এবং ঝগড়াবিবাদ ও হানাহানিতে লিপ্ত হয় তাহলে সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এখন থেকে কুড়ি বছর আগে মরহুম মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) আলেম সমাজকে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে বলে যে আহবান জানিয়েছিলেন আজো তার গুরুত্ব সমভাবে প্রযোজ্য। মসজিদে গাউসুল আজমে একদিনের খুতবার বয়ানে তিনি বলেছিলেন, ‘আজকাল দেশটা ভন্ড আলেমে ভরে গেছে। পোশাকে আলেম, কিন্তু ভিতরে কোরআন-হাদিসের ইলম নেই, তাদের অধিকাংশই কোরআন-হাদিস জানে না। কোরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা করে। মানুষ তাদের অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। কোরআন-হাদিসের মনগড়া ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা করে সরলপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করার ধারা আগেও ছিল, এখনো অব্যাহত আছে। এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী ও স্বার্থপর ভন্ড আলেমের পদচারণা সব দেশের সব সমাজে লক্ষ করা যায়, যারা ইসলাম বিদ্বেষীদের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়।’ তাই মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ) প্রকৃত আলেমদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে একই রচনায় বলেন, ‘প্রকৃত আলেমদের দায়িত্ব কর্তব্য হলো জনগণের সামনে কোরআন-হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা, অকপটে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম করা’ (সূত্র: ইনকিলাব, ধর্ম দর্শন, ৪/২/৯৯)।
‘উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব ও কর্তব্য’ সম্পর্কে মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) অপর এক প্রবন্ধে হুজুর (সা.) এর একটি বিখ্যাত উক্তির উল্লেখ করেন, যাতে তিনি বলেছেন, ‘আমার উম্মতের আলিমগণ বনি ইসরাইলের নবীদের সমতুল্য। মুসলিম শরীফের বরাতে অপর এক হাদিসে রসূলুল্লাহ (সা.) কে উদ্ধৃত করে বলেন, আলিম সম্প্রদায় নবীগণের উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশ)’। মওলানা এম. এ. মান্নান আলিম সমাজের উচ্চ মর্যাদার কথা কোরআন ও হাদিসের আলোকে তুলে ধরেন এবং বলেন, ‘তাদের মাধ্যমেই মানবগোষ্ঠি জানতে পেরেছে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতির সঠিক জ্ঞান, দিয়েছে সেই শিক্ষা, যার কারণে আমরা আজ পৃথিবীর বুকে সুসভ্য জাতি মুসলমান। কাজেই নবী-রসূলগণের পর উলামায়ে কেরামগণের মর্যাদা যে কত সু-উচ্চ তাই বর্ণনা করেছেন। আলেম সমাজের মর্যাদা দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিবরণ তুলে ধরার পর মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) ব্যাখ্যা করে বলেন, কেন মুসলিম সমাজ বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে। তাঁর ভাষায়, যতদিন আলেম সমাজ তাদের দায়িত্ব পালনে কোনরূপ ত্রুটি করেন নাই, ততদিন মুসলিমরা বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়নি। অথচ আজ মুসলিম সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতিসহ সর্ব প্রকারের নেতৃত্ব বেনামাজী, ফাসিক, মিথ্যাবাদী লোকদের হাতে চলে গেছে বহুলাংশে। তারা সে দিকে মোটেও কর্ণপাত করছেন না। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। মূলত আলেম সমাজের উ”িত সকল ক্ষেত্রে দাতার ভূমিকা পালন করা। স্নেহ ও মায়ার মাধ্যমেই মানুষকে সত্যপথের দিকে অধিক অনুসারী করা। মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে কথাগুলো বলেছেন। কেননা তিনি ‘জমিয়াতুল মোদারেছীন সংগঠনের দীর্ঘকালের প্রধান হিসেবে দেশের আলেম সমাজের বৃহত্তর অংশের নেতৃত্ব দান করতে গিয়ে এবং রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকাকালে দেশের আলেম সমাজের চিন্তা-চেতনা, মনমানসিকতা, মতামত ও মনোভাবের কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সকলকে ইসলামের ঐক্য ও উদারনীতি অনুসরণের আহবান করেন। একদিকে তিনি ভাষণ-বয়ানে, কর্মকান্ডে সে নীতির অনুসরণ করে চলেন এবং অপরদিকে তার মাধ্যমে ইনকিলাব এবং জমিয়াত সংগঠনকে সেই একই নীতি-আদর্শে পরিচালিত করেন। ‘উলামায়েসু’ বা ভন্ড আলেমদের কবল হতে ইসলামকে মুক্ত রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে ভন্ডপীর ও তথাকথিত মোজাদ্দেদের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি মোজাদ্দেদ কাকে বলা হয় তার ব্যাখ্যা অর্থাৎ শর্তগুলো তুলে ধরেন এবং সত্যিকারের মোজাদ্দেদগণের একটি তালিকা ও প্রদান করেন এবং তাদের অনেকের যোগ্যতা-প্রতিভার কথাও উল্লেখ করেন। লেখার শুরুতেই তিনি বলেন, অসংখ্য মুজাদ্দিদের ভারে ধন্য আজ বাংলাদেশ, যেখানেই যাবেন মুজাদ্দেদ পাবেন। শুধু মহানগরীতেই নয়, প্রতিটি জেলা শহরে এমনকি আজ পাড়াগাঁয়েও মুজাদ্দিদের আগমন ঘটেছে। যদিও রাসূলে পাক (স.) থেকে হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহপাক এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতকের শিরোভাগে এমন লোক সৃষ্টি করছেন যারা তার দ্বীনকে সবল ও সত্যে পরিণত করবেন। (আবু দাউদ) এ হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) মুজাদ্দিদের পরিচয় এবং মুজাদ্দিদ হওয়ার শর্তাবলীর উল্লেখ করেন। বর্তমান যুগ পর্যন্ত যারা মুজাদ্দিদ বলে গণ্য হয়ে এসেছেন তাদের নামের একটা তালিকাও প্রদান করেছেন। যেমন পূর্বে বলা হয়েছে তিনি হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানির (রহ.) সময়ে বাদশাহ আকবরের রাজত্বকালে ভারতবর্ষে ইসলামের যে করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে মুজাদ্দিদ সাহেব তার বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। মওলানা মান্নান (রহ.) তা বর্ণনা করেছেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের অংশটুকু কিছুটা দীর্ঘ হলেও যুগের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এখানে তা আমরা উদ্ধৃত করছি। কেননা বর্তমানে তথাকথিত ‘নব্য’ মুজাদ্দিদগণ ইসলামকে নিয়ে যে ব্যাখ্যা আরম্ভ করেছেন মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) জীবদ্দশায় তা আচ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি সকলকে নব্য মুজাদ্দিদদের খপ্পরে না পড়ার জন্য সর্তক করে দিয়েছেন। তিনি পরিস্থিতি এইভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘আহলে সুন্নাতুল জামাত যাদেরকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে থাকেন, তারা ছিলেন মুজাদ্দিদ কারণ মুজাদ্দিদ হওয়ার জন্য যে সমস্ত গুণাবলীর উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন সেগুলো তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, যখনই বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র ও মূর্খতার কারণে মানুষ খাঁটি ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, সত্য-মিথ্যা যাচাই করার যোগ্যতা হারিয়ে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়ে শরীয়ত গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল তখনই আল্লাহপাক অনুগ্রহ করে এক একজন মুজাদ্দিদ পাঠিয়েছেন। তাঁরা এসে সেই অন্ধকারচ্ছন্ন নির্বোধ পথভ্রান্ত মানুষগুলোকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। মুমূর্ষ অবস্থা থেকে তুলে এনে নব জীবনদান করেছেন। হেদায়েতের আমির সুধা পান করিয়ে খাঁটি মুমিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে আল্লাহর অলিদের থেকে পরিশ্রম ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, কত নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আরাম-আয়েস ছেড়ে পথের ধূলোয় বনে-জঙ্গলে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছে। একটি ঘটনা বললেই কিছুটা অনুভব করা যেতে পারে। তিনি বর্ণনা করেন, উল্লেখিত একই প্রবন্ধের উপসংহারে মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) বলেন, তাই আলিম সমাজের উচিত, লোভ, হিংসা আলস্য, দম্ভ, অবিশ্বাস, মোনাফেকী, অর্থপূজা, ফাঁকিবাজি, চালাকি, স্বার্থপরতা, চাটুকারিতা, ক্ষমতা, শোষণ ইত্যাদি কুৎসিত ব্যাধিগুলো ত্যাগ করে, সত্যিকারের ওয়ারিশাতুল আম্বিয়ার দায়িত্ব পালনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসা, জাহান্নামের আযাব থেকে নিজেকে এবং মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হওয়া। আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দান করুন। আমীন- (সিরাতুল মোস্তাতাকিমের সন্ধানে, পৃ. ৩৩৮-৩৪০)
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, হযরত মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর নিবন্ধিত রচনাবলী ইসলামের রত্ন ভান্ডার। তিনি আমাদের মধ্যে সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও মুসলিম উম্মাহ, বিশেষভাবে এদেশের মুসলমান ও আলেম সমাজের জন্য রেখে গেছেন সুকীর্তিমালার বিরাট স্বাক্ষর ও উৎকৃষ্ট প্রচার মাধ্যম (ইনকিলাব)। পত্রিকাটির বদৌলতে দেশের অবহেলিত ও পিছেয়ে পড়ে থাকা আলেমদের অনেকেই ভালো লেখক হতে পেরেছেন। সুতরাং সঙ্গতভাবে বলা যায়, মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর রেখে যাওয়া প্রচার মাধ্যমের ধর্মীয় পাতা ও কলামগুলো পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে ন্যস্ত তাদের নৈতিক দায়িত্ব হযরত মওলানা সাহবের মূল্যবান গ্রন্থিত প্রকাশিত-অপ্রকাশিত ভাষণগুলো ধারাবাহিকভাবে ইনকিলাবের সংশ্লিষ্ট পাতা ও কলামগুলোতে প্রকাশ করা। এতে তাঁর রেখে যাওয়া জ্ঞান ভান্ডার দ্বারা সবাই উপকৃত হতে পারবে এবং দীনী ইলম ও চিরন্তন হয়ে থাকবে এবং মহামূল্যবান কীর্তিও সংরক্ষিত হয়ে যাবে। আজীবন যিনি জবানে, কলমে এবং অর্থে জাতীয় ও ইসলামের নানামুখী খেদমতে আত্ম-নিয়োগ করেছিলেন, এখন তিনি আমাদের মধ্যে সশরীরে না থাকলেও তার রেখে যাওয়া সুকীর্তির এক বিশাল ভান্ডার আমাদের মধ্যে বর্তমান। নিবন্ধে আমরা নবীগণের উত্তরসূরিদের দায়িত্ব সম্পর্কে মওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর কিছু অভিমত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ হতে তার কিছুটা নমুনা উদ্ধৃত করা হয়েছে মাত্র, তবে এতদসংক্রান্ত আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ উক্তি, বক্তব্য তাঁর অপ্রকাশিত ভাষণ-বয়ানে বিদ্যমান। সেগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে আরো একটি নতুন দিগন্তের উম্মোচন হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন