শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

বই উৎসবের অর্জন স্লান হচ্ছে ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়ে

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল কুমিল্লা থেকে : | প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

জানুয়ারির ১ তারিখে বই হাতে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল কুমিল্লার শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কুমিল্লার বই উৎসবের অর্জন স্লান করে দিচ্ছে ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি আদায়ে। কুমিল্লায় সরকারি বেসরকারি স্কুলগুলোয় টিউশন-ফি, সেশন চার্জ ও ভর্তি-ফি আদায় নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো ফি আদায় করছে। এ নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা কেউই মানছে না। শিক্ষা প্রশাসন এ বিষয়ে এখনও নির্বিকার।
অভিভাবকদের অভিযোগ, এ নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। তবে একজন শিক্ষার্থী তার নিজের স্কুলেই নতুন ক্লাসে উঠতে ‘ভর্তি ফি’র নামে কেন এত টাকা দিতে বাধ্য হবে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যাও নেই বিদ্যালয়গুলোতে। আর এই টাকা দিতে না পারলে মিলবে না বিনামূল্যের সরকারি বইও। ফলে শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে অনেক অসচ্ছল পরিবারের শিশুদের।
কুমিল্লার চরগোয়ালি খন্দকার নাজির আহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়, পিপিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, কেরনখাল উচ্চ বিদ্যালয়সহ কুমিল্লার অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ফি আরোপের অভিযোগ অভিভাবকদের। তবে এ বিষয়ে চরগোয়ালি খন্দকার নাজির আহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্র চন্দ্র দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, স্কুলের বৈদ্যুতিক বিল, কম্পিউটার চার্যসহ বিভিন্ন খাতে টাকা নেওয়ায় কারণে সব মিলিয়ে ভর্তির সময় একটু বেশি টাকা নিতে হচ্ছে।
তবে তিনি আরো বলেন যে, তার পাশের স্কুলে আরো বেশি নিচ্ছেন বলে জানান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রফেসর রুহুল আমিন ভূঁইয়া ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি যারা নিচ্ছে তারা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে বলে মন্তব্য করে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা এই বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। ইতিমধ্যে কুমিল্লার লাকসামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা কুমিল্লা বোর্ডের আওতাধিক প্রত্যেকটি বিদ্যালয় সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছি। তবে অভিভাবকের পক্ষ থেকে শিক্ষা বোর্ডকে অতিরিক্ত ফি নেওয়ার ব্যাপারে অবহিত করলে আমরা আরো জোড়ালো ভুমিকা রাখতে পারবো বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
কুমিল্লার মহানগরী ও জেলা-উপজেলার অধিকাংশ স্কুলে নতুন বই পেতে তৃতীয় থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া শিশুদের অভিভাবকদের গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। জেলার বিদ্যালয়গুলোতে সর্বনিম্ন দু’ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে পাস করে নতুন ক্লাসে উঠতে। তাই এসব স্কুলে পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বছরের শুরুতেই এই টাকা সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অভিভাবকরা জানান, সরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তি যুদ্ধে উত্তীর্ণ হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই বাধ্য হয়ে সন্তানকে এসব স্কুলে ভর্তি করাতে হয়। সরকার এসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বিতরণের বই দিচ্ছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের নির্ধারিত রশিদে টাকা জমা না দেওয়া পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর হাতে সেগুলো দেওয়া হচ্ছে না।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, টিউশনসহ বিভিন্ন ফি আদায়ে সবচেয়ে এগিয়ে কুমিল্লার নামি-দামি বেসরকারি স্কুলগুলো থাকলেও এ ক্ষেত্রে কোন অংশে মফস্বল স্কুলগুলোও পিছিয়ে নেই। এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। অভিযোগ রয়েছে, কুমিল্লার অন্যান্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও এভাবে ভর্তিতে বাড়তি অর্থ নেয়া হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে ইতিমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভর্তি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা রয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিতে এক টাকাও নেয়া যাবে না। যদি কেউ নেয়, অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরেজমিনে গত কয়েকদিনে কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলার বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বেতন আদায়ের রশিদে ২৪ রকমের খাত দেখিয়ে ২ হাজার থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা লিখে অভিভাবকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা জমা দেওয়ার জন্য। কেউ কেউ ধারদেনা করে এই টাকা জমা দিয়ে ভর্তি করাতে পারলেও বেশিরভাগই এসব ফি থেকে অব্যাহতি পাওয়া কিংবা কিছুটা কমানোর জন্য ধর্না দিচ্ছেন দ্বারে দ্বারে। এসব বিদ্যালয়গুলো সুচতুরভাবে তাদের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি করে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা কিংবা এমন প্রভাবশালী রাজনীতিকদের যাদের কাছে টাকা কমানোর সুপারিশ করতে যাওয়া সাধারণ অভিভাবকদের কাছে কল্পনারও অতীত। অনেক অভিভাবক কিছুটা ফি কমানোর জন্য প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা সাক্ষাতও দেন না। অথচ এ সপ্তাহের মধ্যেই এই টাকা জমা দেওয়ার নোটিস দেয়া হয়েছে অধিকাংশ স্কুলে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে, কয়েকজন অভিভাবক বলেন, শিশুরা পাস করার পর স্কুলগুলো যা করছে তা তাদের শিক্ষাজীবনকে ‘জিম্মি’ করে টাকা আদায় ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারি স্কুলে সবাই ভর্তি হতে পারে না। আর এসব স্কুলে ভর্তি করিয়ে অভিভাবকদের বেতন দেয়ার সক্ষমতা থাকলেও বছরের প্রথমে এই গলাকাটা ফি’র রশিদ ধরিয়ে দেয়ার অনৈতিক চর্চা বন্ধ করতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ করা উচিত।
এক হিসাবে দেখা গেছে এসব স্কুলের এক একটিতে ১২শ’ থেকে ১৫শ’ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। নতুন ক্লাসে ওঠার সময় এদের সবার কাছ থেকে এই গলাকাটা ফি নিয়ে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। কোনো কোনো স্কুলে এই আদায়ের পরিমাণ অর্ধকোটি ছাড়িয়ে যায়। অথচ এই টাকা খরচের হিসাব সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক ছাড়া আর কেউ জানেন না। ব্যাংক থেকে এই দু’জনের যৌথ স্বাক্ষরে এই টাকা তোলা হয় যার খরচের খাত অন্যরা জানতে পারে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার শিক্ষা ও আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ মাইনউদ্দিন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নীতিমালার বাইরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এক টাকাও বাড়তি নিতে দেওয়া হবে না। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন