গত কয়েক বছরে দেশের উচ্চ শিক্ষায়তনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য খবরে বলা হয়েছে, যৌন কেলেঙ্কারিতে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বরখাস্ত করা হচ্ছে। ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বরখাস্তের ঘটনা ঘটছে। ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে ২২ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২৮ এপ্রিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৩০ এপ্রিল আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বরখাস্ত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। একই কারণে গত মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত চার বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধশতাধিক যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। একশ্রেণীর শিক্ষকের এই নৈতিক স্খলন নিয়ে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। কেন ও কী কারণে এই নৈতিক অবক্ষয় তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির ঘটনায় সৃষ্ট তুমুল আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটি নীতিমালা তৈরি করা।
দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রী লাঞ্ছনাসহ নানা ধরনের অপ্রীতিকর খবর নতুন কিছু নয়। এর আগেও এ ধরনের অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটেছে। তবে সম্প্রতি এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে ভুক্তভোগী ছাত্রীরা জানিয়েছেন, বাস্তব চিত্র অনেক খারাপ। অনেক ঘটনাই গণমাধ্যমে আসে না। যৌন নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটছে দু-একটি বাদে তার বেশিরভাগই আড়ালে পড়ে থাকে। পারিবারিক, সামাজিক ও লোকলজ্জার ভয়ে ভুক্তভোগীরা এসব প্রকাশ করে না। অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠামাত্রই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের ছাত্রীদের সাথে যে ধরনের অনৈতিক ঘটনা বারবার ঘটছে তা যেন অনেকটা ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েছে তাদের বিষয়টি তো অজানা নয়। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে, এ নিয়ে এখন ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, উচ্চতর আদালত যে ১৬টি বিষয়কে যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে রয়েছে, সরাসরি বা ইঙ্গিতে অশালীন আচরণ, হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি, মন্তব্য বা ভঙ্গি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা প্রভৃতি। বাস্তবতা হচ্ছে, যে শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর ও উত্তম চরিত্রের প্রতীক সেই শিক্ষকদের একটি শ্রেণী তাদের ছাত্রীদেরই কারো কারো সাথে যৌন হয়রানিমূলক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এটা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার।
দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়েই যৌন হয়রানির বাইরেও নানা ধরনের অপকর্ম হওয়ার খবর আমরা প্রায়ই শুনি। খুন, ছিনতাই, মাদক ব্যবসার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ ঘটা অনেকটা নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল উচ্চ শিক্ষায়তনই নয় বরং দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নানা ধরনের অনিয়ম স্থান করে নিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে ও একশ্রেণীর শিক্ষকের মধ্যে অপরাধের এই প্রবণতাকে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত বিষয় দায়ী নাকি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া দায়ী, তা খুঁজে বের করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অভিভাবকরা যদি সন্তানকে শিক্ষাঙ্গনে পাঠিয়ে নিশ্চিত হতে না পারেন, তাহলে তারা কোথায় যাবেন? শিক্ষাঙ্গনে এই নৈতিকতার অবক্ষয় ঠেকাতে আইন যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক অন্দোলন, মূল্যবোধের চর্চা এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা। শিক্ষক নিয়োগের সময়ে কেবল ফলাফলই নয় বরং অতীত সম্পর্কেও খোঁজখবর নেয়া আবশ্যক। পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে কারো পক্ষেই চুপ থাকার সুযোগ নেই। মনে রাখা দরকার, শিক্ষায় নৈতিকতা না থাকলে সমাজে তা আশা করা অর্থহীন। সমাজ নৈতিকতাহীন হয়ে পড়লে কেউই নিরাপদ নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন