বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জনশক্তি রফতানিতে অচলাবস্থা

প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জনশক্তি রফতানিতে এখন একটা নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের শ্রমবাজারগুলোতে বিশেষ করে সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির দুয়ার অনেক দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। অতীতে এসব দেশে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী শ্রমিক কর্ম লাভ করেছিল। এখনো এই দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছে। এসব মুসলিম দেশে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ উচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছিল। এ অবস্থাটি কেন পরিবর্তিত হয়ে গেল, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। এমন নয় যে, দেশগুলো জনশক্তি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। বাস্তবতা হলো, প্রতিটি দেশই বিদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেলেও এ কারণে তাদের উন্নয়ন কার্যক্রম থেমে গেছে কিংবা বড় ধরনের কোনো সঙ্কট দেখা দিয়েছে, এমন কোনো খবর নেই। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি তারা বন্ধ রাখলেও অন্যান্য দেশ বিশেষত ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া থেকে তারা ঠিকই প্রয়োজনীয় জনশক্তি আমদানি করছে। এমনিতেই যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশের শ্রমবাজার প্রায় বন্ধ রয়েছে। বাকি দেশগুলোতেও বাংলাদেশ অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা বা বন্ধের শিকার হয়েছে। এতে এটা স্বভাবতই প্রতীয়মান হয়, শ্রমবাজারগুলো ধরে রাখা কিংবা বদ্ধ দুয়ার খোলার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ-পদক্ষেপ, যোগাযোগ, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো অপরিহার্য ছিল, সরকার তা চালায়নি বা চালাতে পারেনি। এটা একটা বড় ধরনের ব্যর্থতা, তার দায় সরকারের ওপরই বর্তায়।
২০০৯ সাল থেকে সউদী আরব, ২০০৭ সাল থেকে কুয়েত, ২০১২ সাল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ওদিকে ২০০৯ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। সউদী আরবে কিছু মহিলা কর্মী নিয়োগের সমঝোতা হলেও তা খুব কার্যকর হয়নি। ইতোমধ্যে দেশটি ৭০ হাজার বিদেশী কর্মী ছাঁটাইয়ের পদক্ষেপ নিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য বড় রকমের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি সউদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এলেও জনশক্তি রফতানির ব্যাপারে তেমন কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি। একইভাবে কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়ও কোনো সুখবর পাওয়া যায়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি নেয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করলেও কবে নাগাদ তা কার্যকর হবে, বলার উপায় নেই। বহু আলাপ-আলোচনা ও দেন-দরবারের পর জি-টু-জি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণ শুরু হলেও তিন বছরে মাত্র ১০ হাজার শ্রমিক সেখানে যেতে পেরেছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দু’দেশের মধ্যে জি-টু-জি প্লাস সমাঝোতা স্বাক্ষরিত হলেও সেটা পরদিন স্থগিত ঘোষিত হয়েছে। অবস্থাটা এমন যে, কোনো দিকেই আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এই সমূহ অচলাবস্থার কারণে জনশক্তি রফতানি আয় বা রেমিট্যান্স উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল আনুমানিক এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে ১০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৯৬ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স কম হবে ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এক বছরে রেমিট্যান্সে এই বিরাট ধস দেশের জন্য কতটা উদ্বেগজনক, সহজেই তা অনুমেয়।
এ কথা কারো অজানা নেই, দেশের অর্থনীতির প্রধান দু’টি স্তম্ভের একটি হলো রেমিট্যান্স; অপরটি হলো গার্মেন্ট পণ্য রফতানি আয়। এ দু’টি স্তম্ভের ওপরই মূলত অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, জনশক্তি রফতানি যেমন প্রায় থেমে গেছে, আয়েও যার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তেমনি গার্মেন্ট পণ্য রফতানি সামান্য বাড়লে আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা বা প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, অর্থনীতির ভবিষ্যৎ ও দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিয়ে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। কেন জনশক্তি রফতানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না, বন্ধ শ্রমবাজার খোলা যাচ্ছে না, সেটা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। গার্মেন্ট পণ্য রফতানিতে সব ধরনের সুযোগ কেনই বা যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না, আয় বাড়ানো যাচ্ছে না, সেটাও খতিয়ে দেখা জরুরি। ইতোমধ্যে হাজার হাজার গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং এসব কারখানায় কর্মরতরা বেকার হয়ে পড়েছে। এটা একটা বড় রকমের অশনি সঙ্কেত। জনশক্তি রফতানিই হোক, আর গার্মেন্ট পণ্য রফতানিও হোক, এ জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। দুঃখের বিষয়, সর্বক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থা বিদ্যমান থাকলেও জনশক্তি আমদানিকারক মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে গভীর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়নি। একইভাবে গার্মেন্ট পণ্য আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করা সম্ভব হয়নি। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকার উভয় ক্ষেত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে এক ধরনের অবহেলা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করে যাচ্ছে। বিশেষ একটি দেশের সঙ্গেই কেবল সরকার সম্পর্ক বাড়ানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছে। এই অভিমতের প্রেক্ষিতে বলতেই হবে, জাতীয় স্বার্থে সব দেশের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা অপরিহার্য ও আবশ্যক। এতে কাক্সিক্ষত সুবিধা ও সাফল্য পাওয়া সম্ভবপর হবে। সরকার এদিকে আশু দৃষ্টি দেবে, এটাই আমরা কামনা করি।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন