প্রতিটি যুগেই প্রতিটি আন্দোলনে এমন কিছু অনন্য ব্যক্তিত্ব থাকেন যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মানুষের কাছে তাকে মহিমান্বিত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় করে তোলে। আর যদি সেটা কোন আদর্শিক আন্দোলনে হয়, তবেতো কথাই নেই। মরহুম মাওলানা এ কিউ এম ছিফাতুল্লাহ সাহেব ছিলেন সেই ধরনের এক ব্যক্তিত্ব। ১৯৩৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর শেষ জুমাবার চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ থানার সেন্দ্রা গ্রামে জুমার আযানের সময় মাওলানা এ কিউ এম ছিফাতুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ। তিনি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
শিক্ষা জীবন: তিনি ১৯৪২ সালে পালিশারা হাই মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেন। ১৯৪৫ সালে তাঁর পিতা তাকে নিজ গ্রাম হতে আধা কিলোমিটার দূরে বেলচো কারিমাবাদ মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। তিনি যখন এ মাদরাসায় অধ্যয়ন করছিলেন তখন সমগ্র ভারতব্যাপী মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী জোরদার হয়। তিনি মাদরাসাটিতে ইবতেদায়ী ৪র্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। ১০ বছর বয়সে তিনি বয়েজ ন্যাশনাল গার্ডে যোগদান করে কিশোরদের একটি প্লাটন গঠন করেন। ফলে কমান্ডারের দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়। ১৯৪৬ সালের রেফারেন্ডামে পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের জন্য প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মাইল পায়ে হেঁটে মিছিল পরিচালনা করতেন। সেই মিছিলে ¯েøাগান ছিল ‘লড়কে লেয়েঙ্গি পাকিস্তান, কবুল মোদের জান পরান’। পাকিস্তানের উৎস কি? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ইত্যাদি।
সেই মাদরাসায় আলিম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি তার প্রতিবেশী মুরুব্বী বিশিষ্ট সমাজনেতা জনাব নূরুল হুদা পাটোয়ারীর জ্যৈষ্ঠ সন্তান ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মরহুম আব্দুল মান্নান সে সময়ে সরাসরি কম্যুনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন। তারই প্রভাবে তিনি মাদরাসা ছাত্র হয়েও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে যান। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তরুন ছাত্র নেতা হিসেবে বিভিন্ন জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করে মিছিল থেকে গ্রেফতার হন এবং কয়েক ঘন্টা থানায় আটক রাখার পর ছেড়ে দেয়া হয়। ১৯৫২ সালে বেলচো মাদরাসা হতে আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৫৩-৫৪ সালে গাজীপুড়া কামিল মাদরাসা হতে ফাজিল উত্তীর্ণ হন। এ সময়ে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে অনেক দূর অগ্রসর হন। গাজীপুড়া মাদরাসায় পড়াকালীন মাওলানা আবুল আলা মওদূদী রহ. এর মুসলমান আওর মওজুদাহ, সিয়াসী কাশমকাশ ১ম খÐ ও ২য় খÐ পড়ে মাওলানার ব্যক্তিত্ব ও পান্ডিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন। ১৯৫৪-৫৫ সালে ছারছিনা আলীয়া মাদরাসায় অধ্যয়নকালে মাওলানা আবদুর রহীম ও মাওলানা মওদূদীর সাথে সরাসরি পত্রালাপ ও সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন প্রশ্নাদির জবাব প্রাপ্তির পর ১৯৫৫ সালে ইসলামি আন্দোলনের মুত্তাফিক হন। বিভিন্ন পর্যায়ে ড. মুস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক আখতার ফারুক, অধ্যাপক শিহাবুদ্দীন, অধ্যাপক শামসুল হক, এ.বি.এম. মুসলিম, মাওলানা মুরশীদ আলমসহ ৭০ জনের মতো কামিল ১ম ও ২য় বর্ষের ছাত্র সম্মিলিতভাবে ছারছীনায় মুত্তাফিক সংগঠন কায়েম করেন। সে সময় নাজেমের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়।
১৯৫৫ সালে তিনি সহ ২৫ জন ছাত্রকে রাজনৈতিক কারণে ছারছিনা মাদরাসা থেকে বহিস্কার করা হয়। একই মাসে প্রিন্সিপাল মাওলানা তাজ্জীমুল হোসাইন খানের স্বাক্ষরিত বদলির সার্টিফিকেট নিয়ে ঐ বছরই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কামিলে উত্তীর্ণ হন। প্রিন্সিপাল তাঁকে এত স্কনেহ করতেন যে, স্থানান্তর সার্টিফিকেটের চরিত্রের কলামে সে উত্তম চরিত্রের অধিকারী শব্দ লিখে সার্টিফিকেট প্রদান করেন। তিনি বি.এ.অনার্স, এম.এ. রাষ্ট্রবিজ্ঞান (রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়), এম.এ. ইসলামিক স্টাডিজ ১৯৯৮ (এশিয়ান ইউনিভার্সিটি) থেকে সমাপ্ত করেন। ভাষাগত দিক থেকেও তিনি বেশ পারদর্শী ছিলেন। বিশেষ করে বাংলা, ঊর্দূ, আরবি, ফার্সী ও ইংরেজীতে তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন।
কর্মজীবন: তাঁর বহুমূখী কর্মময় জীবন সত্যিই ঈর্ষার যোগ্য। জীবনের সমস্ত সময় তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন বহুবিদ কর্মকাÐের সাথে। এ যেন সময়ের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের অনন্ত প্রচেষ্টা। তার অসাধারণ কর্মকাÐ শুধুমাত্র বর্তমানকে নিয়েই সীমাবদ্ধ নয় বরং তার রচিত অর্ধশতাধিক বই ভবিষ্যত প্রজন্মকেও তার চিন্তা ধারায় প্রভাবিত করবে এবং তাদের চিন্তার খোরাক জোগাবে ইনশাআল্লাহ। তিনি ১৯৫৬-১৯৫৮ মাগুরা সিদ্দিকীয়া সিনিয়র মাদরাসায় সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৫৮-১৯৬০ হেড মাওলানা হিসেবে মাসিমপুর সিনিয়র মাদরাসা, চাঁদপুরে দায়িত্ব পালন করেন। এর পরে তিনি সুপারিনটেনডেন্ট, সোনাইমুড়ি সিনিয়র মাদরাসা, চাঁদপুর এবং ১৯৭৩-১৯৭৬ প্রধান মুহাদ্দিস, হামিদপুর আলীয়া মাদরাসা, কলারোয়া, সাতক্ষীরায় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬-১৯৮২ ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে খুলনা নেছারিয়া আলীয়া মাদরাসা, মুজগুন্নি, খুলনাতে দায়িত্ব পালন করেন। তার পর তিনি ১৯৮২-১৯৯৯ ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে তা’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, মীরহাজিরবাগ, ঢাকাতে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ২০০০-২০০৩ সালে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট মাদরাসা, উত্তরা, ঢাকাতে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে হাজেরা আলীয়া ক্যডেট মাদরাসা, হাজিগঞ্জ, চাঁদপুরে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০০৪-২০০৫ সনে মুহাদ্দিস হিসেবে মিসবাহুল উলুম কামিল মাদরাসায় কর্মরত ছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলী : তাঁর স্বরচিত গ্রন্থাবলী নিম্নে উল্লেখ করা হলো: ইসলামী আইন ও রাষ্ট্র, বর্তমান বিশ্ব ও ইসলামী আইন, আমাদের আযাদী সংগ্রাম ও জাতীয় আদর্শ, আমাদের শাসনতান্ত্রিক সংকট ও সমাধান, আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসা ও ইসলাম, সীরাত রচনাবলী, ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং, ইসলামী সমাজ গঠনে মহিলাদের দ্বায়িত্ব, ইসলামী দর্শন, মানবাধিকার ও ইসলাম, কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন ও আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি, ইসলামী জীবন দর্শনে হজ্জ ও যাকাতের অবদান, কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন ও মাদরাসা শিক্ষা, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা, কাদিয়ানী মতবাদ ও ইসলাম এবং প্রবন্ধকার ইসলামী কোষ। এছাড়াও তাঁর সম্পাদিত ও অনুবাদকৃত বিভিন্ন বই রয়েছে।
সাংবাদিকতা : তিনি স্টাফ রিপোর্টার, অধুনালুপ্তা দৈনিক ইত্তেহাদ, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি ও ভূতপূর্ব নিজস্ব প্রতিনিধি, দৈনিক সংগ্রাম, নিজস্ব প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক জাহানেনও, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি, দৈনিক সমাচার, সহকারী সম্পাদক, মাসিক আল ফুরকান, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক জনবার্তা, খুলনা ও সহকারী সম্পাদক, মাসিক চিন্তাভাবনা, ঢাকাতে যোগ্য ও দক্ষ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এই মহা মানবের মৃত্যুকালীন ঘটনা : মৃত্যু জীবনের সব থেকে ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী তার বহু প্রমাণ প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে রেখে চলেছে। দেশের খ্যাতিমান ইসলামী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, দেশ বরেণ্য মুফাসসিরে কুরআন শায়খুল হাদিস মুহতারাম মাওলানা এ. কিউ. এম. ছিফাতুল্লাহ মাদরাসা শিক্ষক পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় ২২ ডিসেম্বর ২০০৫, বৃহস্পতিবার সকাল ১১:১৫ মিনিটে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে বক্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এক মুহূর্ত আগে যিনি অবিলম্বে ফাজিলকে ডিগ্রী এবং কামিলকে মাস্টার্সের মান দেয়ার জন্য সরকারের নিকট দাবী জানালেন, পর মুহূর্তেই তিনি লাশে পরিণত হলেন। জীবন আর মৃত্যুর দুরত্ব এতটুকু যে, শ্বাস ফেলা হয়েছে আর নেয়া যায়নি অথবা শ্বাস নেয়া হয়েছে আর ফেলা যায়নি। আসরের নামাযের পর বায়তুল মোকাররম জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রথম জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় জামাত অনুষ্ঠিত হয় তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ত’মিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা প্রাঙ্গণে। তাঁর জানাজার নামাজে ইমামতি করেন মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা জায়নুল আবেদীন। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় হাজিগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত হাজেরা আলী ক্যাডেট মাদরাসা মাঠ প্রাঙ্গণে সর্বশেষ নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাঁর পিতা মাতার কবরের পাশেই তাকে দাফন করে চির শায়িত করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি ৬ পুত্র ও ৩ কণ্যা রেখে যান। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন