শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মোজেস মিরাকল

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ | প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

মহান আল্লাহ্র বিস্ময়কর সৃষ্টি ও নিদর্শনাবলী সম্পর্কে জ্ঞান ও ভাবনা-চিন্তা আসলে তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা আরো বেড়িয়ে দেয়। তাই তো জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবাক করা তত্তে¡র সান্নিধ্যে পৌঁছে মুসলিম মনীষীগণ ঈমানদারের স্বভাবসুলভ বিনয়াবনত চিত্তে ঘোষণা করেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি এ গুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি’ (আল ইমরান: ১৯১)।
মহান আল্লাহ্র সৃষ্টির বিস্ময়কর নিদর্শন ‘মোজেস মিরাকল’। মহান আল্লাহ্র আদেশে নীল নদের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরি হওয়ার ঘটনার সঙ্গে মোজেস মিরাকলের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ঘটনাটি দক্ষিণ কোরিয়ার শিনদোর এক রহস্যময় দ্বীপ নিয়ে আবর্তিত। এ বিস্ময়কর দ্বীপ স্মরণ করিয়ে দেয় মহান আল্লাহ্র বাণী, ‘জ্ঞানের অতি সামান্যই তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে...’ (সুরা বানি ইসরাইল: ৮৫)।
হযরত মুসা ইবনু ইমরান কামাত ইবনু লাওয়া ইবনু ইয়াকুব (আ. জন্ম-মৃত্যু, আনুমানিক ১৫২৭- ১৪০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও ফিরাউন প্রসঙ্গের বর্ণনা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ঐ দ্বীপের বাস্তব চিত্রের মিল থেকেই তৈরি হয়েছে ‘মোজেস মিরাকেল’ বিষয়ক কিংবদন্তি। এ দ্বীপেও খুঁজে পাওয়া যায় আল কুরআনের বাণীর নিত্যতা, ‘(স্মরণ করো) যখন আমি তোমাদের জন্য সাগরকে দ্বিধাবিভক্ত করেদিলাম, তারপর আমি তোমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি ফিরাউন ও তার দলবলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তোমরা তো (নিজেরাই) তা প্রত্যক্ষ করছিলে’ (বাকারা: ৫০)। অন্যত্র মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘আমি বানি ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। তখন ফিরাউন ও তার বাহিনী অত্যাচার ও সীমালংঘনের উদ্দেশ্যে, তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। তারপর যখন সে ডুবে মরার উপক্রম হলো, তখন বলতে লাগলো: আমি স্বীকার করলাম, বানি ইসরাইল যে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। (আল্লাহ্র পক্ষ থেকে উত্তর দেওয়া হলো) এখন ঈমান আনছ? অথচ এর আগে তো তুমি অবাধ্যতা করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’ (ইউনুস: ৯৯, ৯১)।
যদিও মোজেস মিরাকল বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্য রকম কিংবদন্তি। দক্ষিণ কোরিয়ার শিনদো আইল্যান্ড আসলেই এক রহস্যঘেরা দ্বীপ। এরই পাশে অবস্থিত মোদো নামের আরেকটি দ্বীপ। দ্বীপ দু’টির অবস্থান পাশাপাশি হলেও পারস্পরিক দূরত্ব একেবারে কম নয়, মাঝে উত্তাল- অথৈ সাগর। অথচ, বছরের প্রতি বসন্ত ও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়কালে দু’বার শিনদো ও মোদো দ্বীপ দু’টির মধ্যবর্তী সাগরের পানি সরে গিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে রাস্তা সৃষ্টি হয়। রাস্তাটির দৈর্ঘ্য ২.৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৪০ মিটার, যেন এক সংযোগ সড়কের মাধ্যমে দ্বীপ দু’টি পরস্পর সংযুক্ত। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, রাস্তাটির স্থায়ীত্বকাল হয় মাত্র একঘণ্টা! ঘটনাটি ঘটে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নিয়মে। পবিত্র কুরআন ও বাইবেলের বিভিন্ন সুসমাচারে বর্ণিত হযরত মুসা (আ.) ও ফিরাউনের কাহিনীর সঙ্গে মিল থাকার কারণে অনেক কোরিয়ান এ ঘটনাকে ‘মোজেস মিরাকেল’ বলেন।
প্রাচীন মিশরীয় সম্রাটের রাজকীয় উপাধি ফারাও বা ফিরাউন। প্রচলিত ফিরাউন বলতে দ্বিতীয় রামসিসকে বোঝায়। ফিরাউন ১৮তম রাজবংশের তৃতীয় শাসক। ফিরাউনের অপর নাম কাবুস। তাফসির ইবনু কাসিরে ফিরাউনের পূর্ণ নাম বলা হয়েছে- ওয়ালিদ ইবনু মুসাইয়্যিব ইবনু রাইয়্যান। প্রাচীন মিশরের রাজধানী পেন্টাটিউক। নীল নদ তীরবর্তী এ নগরীই ছিল ফিরাউনের আবাসস্থল। সে ছিল কুখ্যাত শাসক। ফিরাউন নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক ঘোষণা করে। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘সে বলল, আমি-ই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিপালক বা রব। পরিণামে সে আল্লাহ্র ইহ-পারলৌকিক শাস্তিতে নিপতিত হলো। নিশ্চয়ই এর মধ্যে রয়েছে ধর্মভীরুদের জন্য চরম শিক্ষা’ (নাযিয়াত: ২৪-২৬)।
পাপাচারী ফিরাউন ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে মুসার (আ.) অনুসারীদেরকে তাড়া করে লোহিত সাগর তীরে নিয়ে আসে। মুসার (আ.) অনুসারীরা বলতে থাকে ‘আমরা তো ধরাই পড়ে গেলাম...’। তখন মহান আল্লাহ্র হুকুমে মুসা (আ.) তার হাতের লাঠি দিয়ে সাগরে আঘাত করেন, সঙ্গে সঙ্গেই মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারী বানি ইসরাইলের জন্য সাগরের মধ্য দিয়ে বারটি রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা নিরাপদে চলে যান ওপারে, আর ডুবে মরে ফিরাউনের বাহিনী। এভাবেই মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ফিরাউনের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো: ‘সুতরাং আমি তাকে ও তার বাহিনীকে ধরলাম এবং তাদেরকে সাগরে নিক্ষেপ করলাম’ (কাসাস: ৪০)। ১৮৮১ সালে মিশরের এক নদীর উপত্যকায় (পাহাড়ের মাঝখানে, যেখান দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়েছে) ফিরাউনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে শিনদো আইল্যান্ডের ‘মোজেস মিরাকল’ ১৯৭৫ সালের পর ব্যাপক পরিচিতি পায়, তখন একজন ফরাসি কূটনীতিক শিনদো দ্বীপ ঘুরে এসে তাঁর দেশের ফরাসি পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এরপর, প্রতি বছর বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটক শিনদো দ্বীপ এলাকায় ভ্রমণে আসেন ‘মোজেস মিরাকেলে’র টানে। ২০১৭ সালের ৭ এপ্রিল ছিল ‘মোজেস মিরাকেল ডে’। দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ ‘মোজেস মিরাকেল’ বা সাগর দ্বিধাবিভক্ত হবার অদ্ভুত ঘটনাটি উৎসবের আমেজে পালন করে। উৎসবের নাম ‘শিনদো মিরাকল সি রোড ফেস্টিভ্যাল’। পর্যটকদের কাছে উৎসবটি যেমন দুর্লভ ও সৌভাগ্যের, তেমনই দারুণ উপভোগ্য। সাগরের পানি সরে গিয়ে তৈরি হওয়া রাস্তা থেকে পর্যটকগণ শামুক, ঝিনুক ও ছোট ছোট মাছ ধরতে পারে ঠিকই। তবে খেয়াল রাখতে হয় সময়ের দিকে। কারণ, রাস্তাটির স্থায়ীত্বকাল মাত্র একঘণ্টা। এরপর তা তলিয়ে যায়। ফলে সময় নষ্ট হলেই অনিবার্য মৃত্যু!
‘মোজেস মিরাকেল’ বা সাগর দ্বিধাবিভক্ত হবার রহস্যেরও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। ঘটনার মূল কারণ হলো, বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত এ অঞ্চলের সাগরে ভাটার সময়কাল। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কেনো প্রতি বছর ঐ সময়ে সাগর দ্বিধাবিভক্ত হয়? বিজ্ঞানীগণের ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়, পৃথিবীর ওপর সূর্য ও চাঁদের আকর্ষণের ফলে জোয়ার ভাটা হয়। এমন জোয়ার ভাটা সারা বছর থাকলেও, কেনো ঐ সময়ে সাগর দ্বিধাবিভক্ত হয়, এমন জিজ্ঞাসার সন্তোষজনক জবাব আছে, ‘টাইডাল হারমনিকস’ বিষয়ের ধারণায়।
সহজ কথায় বলা যায়, সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী নিজস্ব কক্ষপথে আবর্তনকালে তাদের অবস্থান এমন এক নির্ধারিত স্থানে এসে দাঁড়ায় যখন চাঁদ ও সূর্যের সম্মিলিত আকর্ষণে পৃথিবীর নির্দিষ্ট স্থানে জোয়ারের পরিমাণ অনেক কম থাকে। আর শিনদো দ্বীপের ঐ স্থানটি একটু উঁচু হবার সুবাদে পানি সরে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রাস্তা তৈরি হয়। অন্যদিকে জোয়ার ভাটা তথা চন্দ্র-সূর্যের আবর্তন সবই তো হয় মহান আল্লাহ্র আদেশে। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘সূর্যের এ ক্ষমতা নেই যে, সে চাঁদকে নাগালের মধ্যে পাবে- না রাত দিনকে অতিক্রম করে আগে চলে যেতে পারবে; এরা (চন্দ্র-সূর্য) সবাই শূন্যলোকে সাঁতরে চলছে’ (ইয়াসিন: ৪০)।
বিজ্ঞান ও বাস্তবের বাইরে, ‘মোজেস মিরাকেল’ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থানীয় নানান লোক উপাখ্যান প্রচলিত আছে। বহুল প্রচলিত ঘটনাটি হলো, একদা শিনদো দ্বীপে অসংখ্য বাঘ থাকতো, প্রায়ই বাঘ লোকালয়ে আক্রমণ করতো। একবার বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য গ্রামের সবাই মোদো দ্বীপে পালিয়ে যায়। শুধু পালাতে পারেনি এক বুড়ি। নিরূপায় বুড়ি, লোকবিশ্বাসের সাগর দেবতার কাছে তার অসহায়ত্বের করুণ আর্তি জানায়। দেবতা তাকে সান্ত¦না দিয়ে জানায়, পরদিন সাগরে রংধনুর মতো পথ দেখা যাবে। পরদিন বুড়ি সাগর পাড়ে গিয়ে দেখে, ঠিক ঠিকই সাগরের মধ্য দিয়ে একটি পথ বা রাস্তা তৈরি হয়েছে। এজন্যই শিনদো দ্বীপে এক কাল্পনিক বুড়ি ও বাঘের ভাস্কর্য রয়েছে। সত্য কথা বলতে কী, লোক উপাখ্যান বা কিংবদন্তি মাত্রই অর্ধ-সত্য ও অর্ধ-ঐতিহাসিক। সত্যের খোলস ইতিহাস এবং ইতিহাসের কঙ্কাল কিংবদন্তি। ঐ কঙ্কালে কল্পনার লেবাস লাগিয়ে ইতিহাস হেঁটে চলে মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায়। বস্তুতঃ ‘মোজেস মিরাকল’ জনশ্রুতি, গল্প-গীত, ইত্যাদির যত্মে কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে আছে পরম সম্মানে ও গর্বের মান্যতায়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন