দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ১০ বছরে লোপাট হয়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংক মূলধন ভেঙ্গে ব্যাংক পরিচালিত হচ্ছে। আমানতকারীদের তারা বলে দিয়েছে, ২০ হাজার টাকার উপর চেক দেবেন না। আমানত না আসায় গত দুই বছরে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ৭৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ধার করে গ্রাহকদের ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। ১০ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে চার গুণ। মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর গত সেপ্টেম্বর (২০১৮) শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যে ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপী ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এটা বাংলাদেশের ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক তথ্য। ব্যাংক কর্মকর্তারাই বলেছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩০টির বেশি ব্যাংক এখন ধার করে (ঋণ করে) চলছে। আরো কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। এমন বিপদজ্জনক অবস্থা বিগত ৪৭ বছরে ব্যাংকিং খাতে দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকগুলো সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে , যা মোট ঋণের প্রায় ২৩ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৫৮ ভাগ। বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই হাজার ৩০০ কেটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ ভাগ। বিশেষায়িত দুই ব্যাংক ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা বিতরণের ঋণের ২১ ভাগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, গত জুন ২০১৮ পর্যন্ত ৮৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। অবশ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ২২ নভেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত আরও কয়েক হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে দুই বছরে ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত আমানতের চেয়ে ৭৭ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই পরিমাণ অর্থ ঋণ বা ধার করেছে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দুই বছরে তথা ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৪২ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। এ সময়ে আমানত এসেছে মাত্র এক লাখ ৬৪ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। অংক কষলে দেখা যায়, গত দুই বছরে আমানতের তুলনায় ঋণের পরিমাণ ৭৭ হাজার সাতশ ৪১ টাকা বেশি। বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৭৭ হাজার ১২০ টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আমানত ছিল ৮ লাখ ৯৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আমানত ছিল ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ বিতরণ করছে ৯ লাখ ১৭ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ বিতরণ করে সাত লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ বিতরণ করেছিল ছয় লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতের বর্তমান জটিল সমীকরণ দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে যতদিন সুশাসন আসবে না ততদিন খেলাপি বাড়তেই থাকবে। এক্ষেত্রে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যথাযথ দায়িত্ব পালনের আহবান জানান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ চার দশক ধরে ব্যাংক খাতে গতিবিধি পর্যবেক্ষনণ করেছেন খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, বিএনপির বড় বার্থ্যতা ছিল সন্ত্রাস দমন করতে না পারা। আর গত দশ বছরে আওয়ামীলীগের বড় ব্যর্থতা ব্যাংক খাতের অরাজকতা বন্ধ করতে না পারা। এসব দূর করতে সাবেক অর্থমন্ত্রীর তেমন জোরালো উদ্যোগ ছিল না। খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণের পুরো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া সত্তে¡ও সে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে দেশে ১০ বছরে বহু নতুন ব্যাংক গড়ে উঠেছে। এদের অবস্থা আরো খারাপ। দেশের সর্বশেষ ৬০তম তফসিল ব্যাংক হিসেবে ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত হয় বেঙ্গল ব্যাংক। অনিচ্ছা সত্তে¡ও বিভিন্ন মহলের লবিং ও সরকারের চাপে নির্বাচনী মাসে এসে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দিতে হলো বেঙ্গলকে। বর্তমানে দেশে নয়টি সরকারি ৪২টি বেসরকারি ব্যাংক এবং ৯টি বিদেশি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে সরকারের কিছু ওভার সাইড দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে আর্থিক খাতে সমস্যা হয়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে লোপাট হয়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। মন্ত্রী বলেছেন এসব কেলেঙ্কারি ঘটেছে মূলত সরকারি ব্যাংকে। এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য মতে, যে কোনো সময়ের তুলনায় দেশের ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে লুট হওয়া ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকার। ব্যবসায়ে সরকারি কোনো ব্যবস্থা সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। বাড়তি খেলাপি ঋণ যাচাই বাছাই ছাড়া ঋণ অনুমোদন, ঋণ বাড়িয়ে নিতে রাজনৈতিক প্রভাব, পরিচালনা পরিষদে রাজনৈতিক পরিচয়, ব্যাংকারদের পেশাদারিত্বের অভাবে দেশের ব্যাংকিং খাত এখন ক্রান্তিকাল পার করছে। ৮ ডিসেম্বর ২০১৮ রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমাদের করণীয় কী’ শীর্ষক এক সেমিনার মুল প্রবন্ধে এসব কথা তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। ১০ বছরে সোনালী, জনতা, বেসিক, এবি, ফারমার্স, প্রাইম, প্রিমিয়াম, এনসিসি, মার্কেন্টাইল, ঢাকা, যমুনা, এনআরবি কমার্শিয়াল, শাহজালাল এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ টাকা লুট হয়েছে। এই লুট হয়ে যাওয়া টাকা দিয়ে দেশে অনেকগুলো উন্নয়ন কাজের অর্থায়ন করা সম্ভব হতো। জনগণের আমানত রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম রোধে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সাথে সরকারের আলোচনায় বসা একান্ত প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মোস্তফা কামাল ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অনিয়ম এবং অরক্ষিত অর্থ ব্যবস্থাকে সুরক্ষার গুরু দায়িত্ব পালন করে জনস্বার্থে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং সচল অর্থনীতির ব্যাপারে আগাম যে প্রতিশ্রুতির বাণী তিনি শুনিয়েছেন তার বাস্তবে রূপ দেওয়ার নীতিগত সিদ্বান্ত গ্রহণ করবেন, এটাই জনগণের একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক: গ্রন্থকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন