বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং পরাশক্তির ভূরাজনৈতিক খেলা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারো একচেটিয়া নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পর ইতিমধ্যে প্রায় ২ সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। নতুন সরকারের নতুন মন্ত্রীরা জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য বড় বড় প্রত্যাশার কথা শোনাচ্ছেন। শেখ হাসিনার নতুন মন্ত্রীসভায় অভিজ্ঞ ও পুরনো মন্ত্রীদের বেশীরভাগেরই ঠাঁই হয়নি। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে নির্বাচনে অনিয়ম-ভোট জালিয়াতিসহ বহুমাত্রিক অভিযোগগুলোর সুরাহা ও রাজনৈতিক সমঝোতা অনেক বড় বিষয়। দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার তার উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং দুর্নীতি বিরোধী অভিযানসহ সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অভিযোগ ও গণঅসন্তোষের একটি রাজনৈতিক সমাধানে আসতেই হবে। সঙ্গত কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করছেন বলেই ধরে নেয়া যায়। যেখানে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বেশীরভাগ রাজনৈতিক দল ও সাধারণ ভোটারদের বর্জন এবং অধিকাংশ আসনে বিনাভোটের সাংসদদের নিয়ে সরকার গঠনের পর বিরোধী দল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে নির্বাচনকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে শীঘ্রই আরেকটি নির্বাচন দেয়ার কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সে অবস্থান থেকে একসময় বিচ্যুত হয়েছিলেন। অন্যদিকে বিরোধী দল ও জোটের পক্ষ থেকেও এমন কোন চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি, যাতে সরকার একটি সংলাপ বা রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে বাধ্য হয়। বিরোধীদল যেন কোনো প্রকার আন্দোলন দানা বাঁধাতে বা সুসংগঠিত হতে না পারে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে তার সব রকম ব্যবস্থা বেশ সফলভাবেই বাস্তবায়িত করেছিল সরকার। উপরন্তু সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের মুখে গত চারবছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল, বিএনপি’র ‘আন্দোলন করার মুরোদ নাই’, সংলাপে বসার মত তেমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, ৫ বছরের একদিন আগেও ক্ষমতা ছাড়বে না মহাজোট ইত্যাদি। বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে, তারেক রহমানকে দেশের বাইরে রেখে, দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নানাবিধ মামলা দিয়ে গ্রেফতার-হয়রানির পরও আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে যেতে ডক্টর কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারটি ছিল দুই পক্ষেই মোক্ষম হাতিয়ার। জনগন ভোট দিতে পারলে এবং ভোট গণনার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে এই প্লাটফর্ম থেকে ধানের শীষ প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে আসার স্বপ্ন দেখেছিল, তা ইতিমধ্যেই অলীক স্বপ্ন হিসেবেই গণ্য হয়েছে। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমানীত হয়েছে যে, বর্তমান বাস্তবতা ও সাংবিধানিক ব্যবস্থায় কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়। একাদশ জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সেই বার্তাই তুলে ধরেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগীতার ক্ষেত্রে অতিব গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের রেমিটেন্স আয়ের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ এখনো এই দুই বাজারে কেন্দ্রীভ‚ত। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বাহিরে বাংলাদেশের অভিবাসি কম্যুনিটির একটি বড় অংশ রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। দশম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য জাতীয় সংলাপ ও রাজনৈতিক সমঝোতার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। সরকার যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিরোধী জোটের কোন দাবী না মেনেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণায় সায় দিল, তখন বোঝাই যাচ্ছিল বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে না গেলেও সরকার আরেকটি একতরফা নির্বাচনের পথেই হাঁটছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড.কামাল হোসেন জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর ত্বরিত জবাব ও সংলাপের দিনক্ষণ ঠিক করার মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দরোজা উন্মোচিত হয়। সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো দাবী না মানলেও বেগম খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে নমনীয় অবস্থান, বিরোধি দলের নেতা-কর্মীদের মামলায় হয়রানি বন্ধের প্রতিশ্রুতি এবং গায়েবি মামলার তালিকা চাওয়াকে ইতিবাচক ও বিশ্বাসযোগ্য বলেই গ্রহণ করেছিল বিএনপি। তবে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি। তফশিল ঘোষনার পর থেকে গায়েবি মামলায় ধরপাকড় অনেক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ধানের শীষের শত শত প্রার্থীকে নির্বাচনী গণসংযোগে বের হতেই দেয়া হয়নি। জেলে আটক হওয়ার বাইরে বেশ কিছু হেভিওয়েট প্রার্থীর গাড়ী ভাঙ্গচুর, রক্তাক্ত হামলার শিকার হয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। চরম অসমতল নির্বাচনী মাঠে শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি’র নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় বিষ্ময় প্রকাশিত হয়েছিল। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে সাংবিধানিক আইনগত বিতর্কের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের চুড়ান্ত তারিখ নির্ধারণের মধ্য দিয়ে এই নির্বাচনে পশ্চিমা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণের পথ পরোক্ষভাবে কিছুটা হলেও রুদ্ধ করে দেয় বলে অভিযোগ উঠেছিল। এরপরও যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল তাদের অনুমতি দিতে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু পর্যবেক্ষক আসতে পারেনি। নির্বাচনটি কেমন হবে বা হতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্ভবত আগেই আঁচ করেছিল। তারা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয় ইনিয়ন বাংলাদেশের এই নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। তবে তারা কয়েকজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞকে পাঠাবে নির্বাচনের সামগ্রিক দিকগুলো নিয়ে একটি রিপোর্ট তৈরীর জন্য। নির্বাচনের ১৫দিন আগে আসা সেই নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এখনো বাংলাদেশে অবস্থান করে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি পূর্নাঙ্গ রিপোর্ট তৈরী করছেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার নির্বাচনের পর প্রায় সব স্টেক হোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় শেষে নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন কংগ্রেসকে অভিহিত করতে ওয়াশিংটন গেছেন বলে জানা যায়।
একাদশ জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে পশ্চিমাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো পাওয়া না গেলেও নানা মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে যে সব প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে তা’ বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জন্য সুখকর নয়। বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষনা সংস্থা উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার ও ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামের একটি নিবন্ধ মার্কিন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধটির শিরোনাম ‘ইলেকশন ওয়াজ স্টোলেন, গভর্মেন্ট ইজ ইল্লেজিটিমেইট’। অর্থাৎ চুরি হয়ে যাওয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার অবৈধ। মাইলামের মতামত এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থান করায় বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে উইলিয়াম মাইলামের বক্তব্যকে মার্কিন নীতি নির্ধারকরা যথেষ্ট গুরত্বের সাথেই গ্রহণ করবে। নিবন্ধের শুরুতেই মাইলাম লিখেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যে সম্ভব নয় তা বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ২০১১ সাল থেকেই বলে আসছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী রীগ তা চুড়ান্তভাবে আবারো প্রমান করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে নির্বাচনে বহুমাত্রিক অনিয়মের অসংখ্য প্রমান, অস্বাভাবিক ভোট টার্ন-আউট এবং নির্বাচনী ফলাফলে প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি এও বলেছেন, নির্বাচনে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি এবং নানাবিধ অনিয়ম ও ভোটচুরির খতিয়ান তুলে ধরতে গেলে নিবন্ধের পরিসরে কুলাবে না। তার মতে, বিএনপিসহ বাংলাদেশের যে কোন রাজনৈতিক সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি ২০০৬ সালে নির্ধারিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপির ভ‚মিকা এবং সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সোভিয়েত যুগের অবসানের পর থেকে বিশ্বের গণতন্ত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। সেই সাথে পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের মাইন্ডসেট সম্পর্কেও তিনি একটি সুন্দর উপমা তুলে ধরেন। যেখানে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে শক্তি প্রয়োগের কৌশল ক্ষনস্থায়ীভাবে সফল হলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রকৃত সত্যই প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে মূলত ২০১৪ সাল থেকেই শেখ হাসিনার অধীনে একদলীয় ও কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সে প্রক্রিয়ায় একটি সিভিলিয়ান ক্যু-দেতা সংঘটিত হয়েছে। এ ধরনের সরকারকে নির্বাচিত সরকার হিসিবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত নয় বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। একাদশ নির্বাচন সম্পর্কে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক সংঘঠনগুলো নির্বাচনের আগে এবং পরে যে সব বিবৃতি প্রকাশ করেছে, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিপক্ষে রাষ্ট্রশক্তি ও সরকারী দলের প্রতিবন্ধকতাগুলোই বার বার উঠে এসেছে। দশম জাতীয় নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার বলেছেন তিনি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চান না। তিনি তার অধীনে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে সংলাপে কোন রাজনৈতিক সমঝোতা না হলেও তার মৌখিক প্রতিশ্রুতির উপর আস্থা রেখেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। নির্বাচনের নামে ৩০ ডিসেম্বর কি হয়েছে তা এখন সবার কাছেই পরিস্কার হয়ে গেছে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা, উন্নয়ন কর্মকান্ড ও বানিজ্য অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। এ থেকে উত্তরণে সরকারকেই আরেকটি মধ্যবর্তি নির্বাচন অথবা বিকল্প গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের পথ প্রধানন্ত্রীকেই খুঁজে বের করতে হবে। সরকার গঠনের পর জাতীয় সংলাপের আহ্বানের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত রাজনৈতিক সমঝোতা ও সমাধানের পথ বের করার ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
চলমান বিশ্বরাজনীতি ও ভ‚-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান পরাশক্তিগুলোর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিগত দশকের শেষার্ধ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একচেটিয়াভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতি এক প্রকার ইন্দো-চায়না পেরিফেরিতে প্রবেশ করেছে। নির্বাচনের অনিয়ম ও নজিরবিহীন ভোট জালিয়াতির ঘটনাকে ঘিরে দেশের সাধারণ জনগণ, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিতর্ক ও অনাস্থা প্রকাশ পেলেও ভারত ও চীনা প্রতিনিধিরা তড়িঘড়ি করে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে এটাই বোঝাতে চাইছে যে শেখ হাসিনার সরকার তাদের বিনিয়োগ ও স্বার্থের জন্য নিরাপদ। অন্যদিকে পশ্চিমারা বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে চায়। যদিও পশ্চিমাদের গণতান্ত্রিক চেতনা অনেকটা আপেক্ষিক ব্যাপার। তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অনুকুলে থাকলে যে কোনো সরকারের সাথেই তারা কাজ করতে রাজি থাকে। মিশর বা তিউনিসিয়ার সামরিক স্বৈরাচার, রাশিয়ার জার, ইরানের শাহ অথবা মধ্যপ্রাচ্যের শেখদের নিরাপত্তার শর্ত হিসেবে তারা গণতন্ত্রের চেয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে। একই ভ‚মিকা ভারত বা চীনের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। এসব পরাশক্তির অর্থনৈতিক ও ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক কনভেনশনের কোনো মূল্য নেই। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের ভ‚মিকা এবং সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর গণহত্যা বা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে চীন-ভারতের ভ‚মিকা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগীতায় লিপ্ত পরাশক্তিগুলো দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর সাথে প্রায় একই রকম আচরণ করছে।
রোহিঙ্গা সংকটসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে প্রথমত: দেশের সব রাজনৈতিক দলকে বৃহত্তর স্বার্থে একটি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সত্যিকার অর্থে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এমন জাতীয় নির্বাচন করা যে অসম্ভব তা ইতিমধ্যে ভালভাবেই প্রমানীত হয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশা অনুসারে এ ধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও ইতিবাচক ভ‚মিকার বদলে নিজ নিজ স্বার্থে খন্ডিত ও অস্বচ্ছ ভ‚মিকা থেকে বিরত থাকতে হবে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে নামকা-ওয়াস্তে একটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করে দেশে একটি ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তরফ থেকে ১১ দফা লক্ষ্যকে সামনে রেখে যে ৭ দফা দাবী তুলে ধরা হয়েছিল তার কোনোটাই সরকার মেনে নেয়নি। অসমতল মাঠে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরী হলেও নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরাজয়। এ থেকে উত্তরণে গ্রহণযোগ্য পথ ও পন্থা এক্ষুনি খুঁজে বের করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে আবারো একটি জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও ভোট ডাকাতির অভিযোগে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবী জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডক্টর কামাল হোসেন। তিনিও এ সমস্যা সমাধানে জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংলাপের বিষয়বস্তু ও লক্ষ্য কি তা এখনো পরিস্কার নয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বে কোনো সংশয় নেই, প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংলাপের লক্ষ্য হল, শুভেচ্ছা বিনিময়। এই যদি সরকারের অবস্থান হয় তাহলে নির্বাচন নিয়ে যে জনঅসন্তোষ ও অনাস্থা তৈরী হয়েছে সহসা তা থেকে উত্তরণের কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না। একাদশ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের মধ্যেও শক্ত ভিন্নমত দেখা যাচ্ছে। ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে নিয়ে পরাশক্তিগুলোর গ্রেট গেইম বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচিত হচ্ছে। দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর পরাশক্তিগুলোর এই খেলায় মতপার্থক্য অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। কোনো দল বা জোটের ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে এ খেলায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গণমানুষের স্বার্থ ও সম্পদের নিরাপত্তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনৈতিক বিভক্তি ও বৈরিতা জিইয়ে রেখে এবং ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত কোনো সরকার দেশের স্বার্থে শক্ত ভ’মিকা পালন করতে পারেনা। তবে সংলাপের মধ্য দিয়ে বৈরিতার অবসান এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি বিশ্বাসযোগ্য মধ্যবর্তি নির্বাচনের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বর্তমান সরকার তার সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হতে পারে।
bari_zamal@yahoo.com

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
Live Projapti ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:২৯ এএম says : 0
পরাশক্তির খেলায়, গনতন্ত্র পরছে ঠেলায়!!
Total Reply(0)
Zulfiqar Ahmed ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৩০ এএম says : 0
বিশ্লেষণ পড়ে খুব ভালো লাগল। আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে।
Total Reply(0)
Hayat Ullah ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৩১ এএম says : 0
এখান গনতন্ত্র তো বলে কিছু নাই, অাছে শুধু তেল তন্ত্র।
Total Reply(0)
Anis Rahman ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৩১ এএম says : 0
দেশ যদি ধ্বংস হয়ে একেবারে শেষ হয়েও যায় তাতে কার কি আসে যায়। আমার কেবল ক্ষমতাটা চাই।
Total Reply(0)
Monir Khan ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৩৫ এএম says : 0
তার মানে অনেক বড় গভীর খাদে হাসিনা নিজে সহ আমাদেরকে ও ফেলে দিয়েছেন !ওহ ! রব রক্ষা করো ,আমাদের কে ! ওদিকে আসামের ৪০ লক্ষ্য ,এদিকে বার্মার ১৩ লক্ষ রেডী ঢুকানোর জন্য ,গার্মেন্টস অস্হির , বিপদ ধেয়ে আসছে !মিসর বা সিরিয়া কোনটির ভাগ্য বরন করবো ,জানিনা ! ইয়া আল্লাহ রক্ষা করো !
Total Reply(0)
Mir Irfan Hossain ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:৪৯ এএম says : 0
We want free Bangladesh, Stop Dellhi Advance
Total Reply(0)
Nannu chowhan ১৬ জানুয়ারি, ২০১৯, ৭:০৮ পিএম says : 0
Absolutely very inspiring explained for the people of Bangladesh but problem is our power greed politicians they never understand what is good & very positive prospiarity for the future generations & the country...
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন