ঢাকার শহরতলীর ১৬টি ইউনিয়নকে দুই সিটি কর্পোরেশনের সাথে যুক্ত করে শহরের আয়তন দ্বিগুণের বেশি বাড়ানো হয়েছে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির (নিকার) সভায় এই অনুমোদন দেয়া হয়। উত্তরে ৮টি এবং দক্ষিণে ৮টি ইউনিয়ন সিটি কর্পোরেশনে যুক্ত হওয়ায় ঢাকার সম্মিলিত আয়তন ১২৯ বর্গকিলোমিটার থেকে ২৭০ বর্গকিলোমিটারে বর্ধিত হবে বলে জানা যায়। সেই সাথে নগরীর সাথে যুক্ত হবে ১৬টি ইউনিয়নের কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ। নগরীর বহুবিধ সমস্যা সমাধানে এই বর্ধিতকরণের উদ্যোগ কতটা কাজে লাগবে তা নিয়েই এখন বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচিত মেয়রদের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সিটির নাগরিক সমস্যাগুলো নিরসনে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। জনপ্রত্যাশা ও জনতুষ্টিমূলক অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়রের পদ গ্রহণের বছর পূর্তিতে দুই সিটি মেয়র প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনয়নে নগরবাসীর কাছে আরো সময় চেয়েছেন। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাহীনতা এবং অব্যবস্থাপনায় বেড়ে ওঠা এই শহরের নাগরিক সমস্যা দু-চার মাসেই সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য তাদেরকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। তবে নাগরিক সমাজ প্রথমেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের শুরুটা দেখতে চায়। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ঢাক-ঢোল পেটানো কিছু উচ্ছেদ অভিযান ছাড়া গত এক বছরে সেই প্রত্যাশিত কর্মকা-ের যাত্রারম্ভ দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের কিছু সাহসী উদ্যোগ নগরবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ ও প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তবে দীর্ঘদিনে জমে ওঠা নাগরিক সমস্যা, নগরবাসীর প্রত্যাশা এবং মেয়রদের দেয়া প্রতিশ্রুতির তুলনায় এক বছরে তাদের অর্জন খুবই কম।
মাত্র ১২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকা নগরীতে ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ বাস করছে। প্রয়োজনীয় পরিকল্পিত রাস্তা, ফুটপাথ, স্যুয়ারেজ লাইন ও বর্জ্যব্যবস্থাপনা, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহব্যবস্থা, যত্রতত্র গড়ে ওঠা বস্তিসহ আবাসন ব্যবস্থার সঙ্কটে নাকাল ঢাকার নাগরিকরা। বিদ্যমান ঢাকা নগরীর বেশিরভাগ মানুষ নাগরিক সুযোগ- সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রথমত, নগরীতে প্রয়োজনীয় রাস্তা, ফুটপাথ ও স্যুয়ারেজ লাইন নেই। এরই মধ্যে বিদ্যমান রাস্তা, ফুটপাথ, স্যুয়ারেজ লাইন ও পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ঢাকাকে বাসযোগ্য ও আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে একটি ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নের উদ্যোগ এক দশকের বেশি সময় ধরে নানাবিধ জটিলতায় আটকে আছে। পরিকল্পিত নগরী গড়ার কারিগরি ও পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছাড়াই নগরীর আয়তন বৃদ্ধির উদ্যোগ পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও দুরূহ করে তুলতে পারে। নগরীর আয়তন দ্বিগুণে উন্নীত করার সাথে সাথে নব সংযুক্ত এলাকার অবকাঠামোগত ও সেবার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা এবং বাজেট সংস্থানের কার্যকর উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। যেখানে দুই সিটি কর্পোরেশনের যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর, গুলশান-বনানী পর্যন্ত রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কগুলোর বিশাল অংশ খানাখন্দে প্রায়ই চলাচলের অনুপযোগী থাকে। সেখানে উত্তরে সাঁতারকুল, ভাটারা, বেরাইদ এবং দক্ষিণে শ্যামপুর, ডেমরা, সারুলিয়া, মান্ডা, দক্ষিণগাঁ ও নাসিরাবাদসহ শহরতলীর বিশাল এলাকা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সেবার মানোন্নয়ন আরো বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।
ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান লাভ করেছে। ঢাকার চার পাশের নদী, জলাভূমি, ভেতরের অসংখ্য খাল ও পরিবেশগত স্পর্শকাতর জায়গাগুলো আমরা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ঢাকার লাইফ লাইন বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে হাজারীবাগ থেকে টেনারী শিল্প স্থানান্তরের সরকারি পরিকল্পনা গত দেড় দশকেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ঢাকার যানজট, জনজট ও বিদ্যমান নাগরিক সমস্যা নিরসনে যেসব উদ্যোগের কথা নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন তার একটি উদ্যোগ হচ্ছে নগরীকে চার পাশে বিস্তৃত করে জনসংখ্যা, প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত পুনর্বিন্যাস নিশ্চিত করা। ড্যাপ বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নিয়ে যেনতেন প্রকারে নগরীকে বর্ধিত করা হলে নাগরিক সেবা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণে তা কতটা সুফল দেবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে। সিটি কর্পোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সাথে সাথে নব সংযুক্ত এলাকার জমির মূল্য হয়তো আরেক দফা বেড়ে যাবে। ঢাকা নগরীকে বাসযোগ্য রাখতে শহরের শিল্প ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি শহরের আশপাশের প্রতিটি জনপদের সাথে উন্নততর কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের অবহেলিত শহরের প্রান্তিক এসব এলাকাকে একটি আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনার আওতায় উন্নত নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার উন্নয়ন বাজেটও অন্তত দ্বিগুণের বেশি বাড়াতে হবে। এসব উদ্যোগ ব্যতিরেকে কেবল নগরীর আয়তন বৃদ্ধি কোনো সমাধান নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন