শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আগামী প্রজন্মের কথাও ভাবতে হবে

প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশে শতভাগ আমদানি নির্ভর কয়লার উপর ভিত্তি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের সিদ্ধান্তে সম্ভাবনার চেয়ে সঙ্কটই বাড়বে। এ প্রসঙ্গে দৈনিক ইনকিলাবের রিপোর্টে বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তার সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, আমদানিতে কোন ধরনের সমস্যা দেখা দিলে কয়লা নির্ভর এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া  আমদানি নির্ভর কয়লায় ইউনিটপ্রতি আনুমানিক উৎপাদন ব্যয় পড়বে যেখানে গড়ে সাত টাকা, সেখানে দেশীয়  কয়লা উত্তোলন করে খনির পাশে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে উৎপাদন ব্যয় ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে  ৪ টাকার বেশি হবে না। তিনি মনে করেন, বর্তমানে আমদানি নির্ভর কয়লাকে কেন্দ্র করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে সরকার চুক্তিবদ্ধ হলেও এক সময় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেশীয় কয়লার উপরই নির্ভরশীল হতে হবে, তখন সমুদ্র তীরবর্তী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দেশীয় কয়লা সরবরাহ করে উৎপাদনে যাওয়াটা অনেক ব্যয়বহুল হবে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে কয়লাখনির কাছাকাছি অবস্থানে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। পৃথিবীর যেসব দেশে কয়লাখনি রয়েছে সেসব দেশে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয় খনির কাছাকাছি। যাতে  করে উত্তোলনকৃত  কয়লা সহজেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেয়া যায়। আমাদের দেশে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এমন জায়গায় হচ্ছে যা ভবিষ্যতে সরকারের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দেবে। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদক মোল্লাহ আমজাদ মনে করেন, শতভাগ আমদানি নির্ভর হয়ে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা  হচ্ছে  ভবিষ্যতে  এসব প্রকল্প  সরকারের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে দেখা দেবে।
দেশের উৎপাদনে উন্নয়নে সাশ্রয়ীমূল্যের বিদ্যুতের কোন বিকল্প নেই। পানি বিদ্যুতের পর কয়লা বিদ্যুতকেই কম খরচের বিদ্যুৎ বলে মনে করা হয়। বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে কয়লার ব্যবহার নিয়ে নানামাত্রিক আলোচনা থাকা সত্ত্বেও হয়ত এটা মেনে নেয়া যেত যদি প্রকৃত বিবেচনায় উদ্দেশ্য সঠিক বলে বিবেচিত হতো। যত যুক্তিই দেখানো হোক না কেন এটা পাগলেরও বোঝার কথা যে দেশের কয়লা ব্যবহার এবং খনির কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হলে তার উৎপাদন খরচও যেমনি কম পড়বে তেমনি এর নিয়ন্ত্রণও নিজেদের উপর থাকবে। নীতিমালার অভাবে আমাদের উন্নতমানের কয়লা পড়ে রয়েছে খনিতে। আর আমরা চুক্তিবদ্ধ হচ্ছি আমদানিতে। এছাড়াও প্রসঙ্গ রয়েছে। যেক’টি প্রকল্প স্থাপনের কথা হয়েছে তার প্রতিটি নিয়েই রয়েছে চরম বিতর্ক। সুন্দরবনের রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে পরিবেশবিদরা বার বার হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন। অন্যদিকে বাঁশখালি নিয়েতো ইতোমধ্যেই পরিস্থিতি ভিন্ন আকার ধারণ করেছে। জাতীয় তেল, গ্যাস, বিদ্যুত ও বন্দর রক্ষা কমিটির প্রধান ড.আনু  মুহাম্মদ  আলোচ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সম্পর্কে বলেছেন, কোন ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এসব বিদ্যুতকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় যে শক্তি মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা পুরো বাংলাদেশকেই অরক্ষিত করে ফেলবে। তার মতে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের জন্য গলার ফাঁসে পরিণত হবে। তিনি সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন, ভারতের এনটিপিসির সাথে বাংলদেশে পিডিবি যৌথভাবে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তা অসম, অস্বচ্ছ এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী। এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, হতে পারে আপাত কোন দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে সংশ্লিষ্টরা বর্তমান প্রক্রিয়াতে লেগে রয়েছেন। এর সুদূর প্রসারী চিন্তা তাদের মাথায় আসেনি। বাস্তবত দেখা যাচ্ছে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে আমাদের সুন্দরবনসহ প্রকৃতির উপর মারাত্মক বিরূুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। সেই সাথে দেশের মানুষও বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দেশের কয়লা উত্তোলনের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আমদানী নির্ভর এসব প্রকল্প কেন খনি এলাকার বাইরে তৈরি করা হচ্ছে সে নিয়েও প্রশ্নের কোন শেষ নেই। মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এসব প্রকল্প খনির কাছাকাছি হলে যখন দেশী কয়লার প্রয়োজন হতো তখন তা অতি সহজেই পাওয়া যেত। বস্তুত, একথাই সঠিক যে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে ধরনের বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়া প্রয়োজন বর্তমান ক্ষেত্রে তার সবটাই উপেক্ষিত হয়েছে। উপরন্তু যারা এ ব্যাপারে অভিমত দিতে চেয়েছেন তারাই বরং নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। এটা কোন বিবেচনাতেই জাতীয় স্বার্থের জন্য ইতিবাচক  হতে পারে না। যেকোন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা অত্যন্ত অপরিহার্য। কারণ কোন উদাহরণ সৃষ্টি হলে তার প্রভাব অন্যত্রও পড়ে।
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যেমনি কোন বিকল্প নেই তেমনি বিদ্যুতের নামে গোটা দেশকে পরনির্ভর করা বা দেশের ভবিষ্যত অন্যের হাত তুলে দেয়া বা আগামী প্রজন্মের জন্য অন্ধকারময় বাস্তবতা তৈরির কোন সুযোগ নেই। দেখে  মনে হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি যেন এক ধরনের গণবিরোধী অবস্থানে গিয়ে ঠেকেছে। অথচ এর উল্টোটি হবার কথা। দেশে বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যুতের অভাব শিল্পায়নের অন্যতম বাধা হিসেবে মনে করা হচ্ছে। কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ও প্রয়েজনীয় বিদ্যুতের অভাব রয়েছে। সে বিবেচনায় বিদ্যুত উৎপাদনের বিষয়টি ব্যাপকভাবে নন্দিত হবার কথা। বিপরীতে কেন নিন্দিত হচ্ছে তা অবশ্যই খুঁজে দেখা দরকার। বিদ্যমান বাস্তবতায় এটাই সংগত যে আগামীতে বিদ্যুতের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে কিভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষা করে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেজন্য বিশেষজ্ঞদের সুপরামর্শ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। মানুষের জন্যই উন্নয়ন। সে কারণেই মানুষ ও প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করে আগামী প্রজন্মের কথা বিবেচনায় রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করাই যুক্তিযুক্ত।    












 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন