ইসরাইলি হামলা আর বর্বরতায় নতুন মাত্রা এনে দিয়েছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৭ সালের শেষের দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পবিত্র জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করার ঘোষণা দেন। এতে মুসলিম বিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে। ফিলিস্তিনিরাও নতুন করে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারপরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকান দূতাবাস জেরুসালেমে স্থানান্তর করেন। এর প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরা অব্যাহত বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালে ফিলিস্তিনের ‘ভূমি দিবস’ থেকে বিক্ষোভ আরও বেগবান হয়। দখলদার বিরোধী বিক্ষোভে ১৯৭৬ সালের ৩০ মার্চ ৬ ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করে ইসরাইলি সেনারা। তারপর থেকে প্রতি ৩০ মার্চ ‘ভূমি দিবস’ পালন করে আসছে ফিলিস্তিনিরা। ২০১৮ সালে ‘গ্রেট রিটার্ন অব মার্চ’ নামে ৩০ মার্চ থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। ৭০ বছর পূর্বে জোরপূর্বক বিতাড়িত তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাঠির অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে তারা এই বিক্ষোভ করেন। ভাবতে অবাক লাগে, একদিকে পৃথিবীর ৬০০ কোটিরও বেশি মানুষ আর অপরদিকে মুষ্টিমেয় ইহুদি জনগোষ্ঠী, সমগ্র পৃথিবী মিলিয়ে যাদের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ লক্ষের বেশি নয়। তাছাড়া শান্তিপ্রিয় সাধারণ ইহুদি যারা এই জায়নিস্ট বা ইহুদিবাদী তৎপরতাকে সমর্থন করেন না; তাদের সংখ্যাটা বাদ দিলে এই জায়নবাদী ইহুদি গোষ্ঠীর সংখ্যাটা একেবারে নগন্য। ইহুদিদের যে জনগোষ্ঠী জায়নবাদী চিন্তাধারার সমর্থক এবং বিশ্বব্যপী ইহুদিবাদী লবীর সাথে সক্রিয় তাদের এই ক্ষুদ্র সংখ্যাটা সামনে রেখে আমরা যদি চিন্তা করি তাহলে সত্যিই অবাক হতে হয় যে, বিশ্বের জনসংখ্যার তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই আগ্রাসনবাদী জায়নিস্টরা কীভাবে পৃথিবীর সকল শান্তিপ্রিয় মানুষের মতকে পদদলিত করতে পারে, পৃথিবীর মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ উপেক্ষা করে তারা তাদের দখলদারি আক্রমণ চালিয়ে যেতে পারে। এত স্পর্ধা তারা কীভাবে দেখাতে পারে?
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল বহুবার শান্তি প্রক্রিয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, অসংখ্যবার যুদ্ধ বেঁধেছে, অসংখ্যবার যুদ্ধ বিরতী হয়েছে। কিন্তু সংকট নিরসনের পরিবর্তে উত্তরোত্তর বেড়েছে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ভালো করেই জানে যে, এ ধরনের শান্তিপ্রক্রিয়া সংকট থেকে উত্তরণের কোন স্থায়ী সমাধান দিতে পারবে না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এই যুদ্ধ পীড়িত ভূখন্ডের স্থিতি কবে আসবে? কবে তাদের মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবে, বিশ্ব দরবারে স্বীকৃত একটি দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বর্তমান বিশ্বের সুপার পাওয়ার আমেরিকার সুপারম্যান ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’ ফিলিস্তিন সংকটের কোন সমাধানের চেষ্টা না করে বরং সংকটকে আরও গভীরতার দিকে ঠেলে দিলেন কোন স্বার্থে? তিনি পরাশক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েও ইহুদিবাদীদের প্রতি এত দুর্বল কিংবা নতজানু হওয়ার কারণ কী?
একটা বিষয় বিশ্ববাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, আমরা বাহ্যিকভাবে যে আমেরিকাকে দেখি তার ভিতরেও আরেক আমেরিকা আছে যার কন্ট্রোল ‘জুইস’ বা ইহুদিবাদী লবীর হাতে। এই ইহুদিবাদী লবীই আজকের আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আজকের আমেরিকার রাজনীতি, অর্থনীতি, স্ট্রাটেজি, টেকনোলজি সবকিছুই এই জুইসদের কুক্ষিগত। আমেরিকান অর্থনীতিতে মাল্টিন্যাশনাল ও বড় বড় সব ইন্ডাস্ট্রি ও কোম্পানিগুলোর মালিকানা অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার ইহুদিদের দখলে। আজকের বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া জুইসরা তাদের মনোপলী করে রেখেছে। আর আমেরিকান অর্থনীতির এসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ইহুদিদের করায়ত্তে থাকার কারণে আমেরিকার রাজনীতি, অর্থনীতি ইহুদি লবীর কাছে অসহায়। বিশেষ করে আমেরিকান গণতন্ত্র ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় তা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ইহুদি জনগোষ্ঠীর দানের মুখাপেক্ষী।
উন্নয়নশীল দেশে স্বার্থান্ধ মহাজনরা যেমন দরিদ্র কৃষকদের দাদন দেয় এবং ফসল উঠলে পানির দরে সিংহভাগ ফসল নিয়ে নেয়, তেমনি আমেরিকার ইহুদিবাদীরা নির্বাচনে প্রার্থিদের ডোনেশন দেয় এবং তাদের নির্বাচনের সুফল কিনে ফেলে। যা তারা দেয় তার সহস্রগুণ সুবিধা তারা আদায় করে নেয়। ব্যয়বহুল গণতন্ত্রের এই রন্ধ্রপথে সিন্দাবাদের ভূতের মতো ইহুদিবাদীরা আমেরিকানদের ঘাড়ে চেপে বসেছে; তাদের স্বার্থের বাহন হয়ে পড়েছে মার্কিনিদের আমেরিকা। এর ফলে শুধু আমেরিকা নয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোরও ক্ষতি ডেকে আনছে। আমেরিকার আন্তর্জাতিক নীতি এই ইহুদিবাদীদের নিজস্ব বিশ্বব্যবস্থা গঠনের নীল নকশারই ফল। নাইন ইলেভেনের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দায় আলকায়দার উপর চাপালেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বিভিন্ন প্রমাণাদী থেকে এটা মানুষের কাছে পরিষ্কার যে, টুইন টাওয়ার ট্রাজেডিতে নাটের গুরু ছিল এই ইহুদিবাদীরাই। এর মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে মুসলিম জাতিকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। টুইন টাওয়ার ট্রাজেডির পেক্ষাপটেই পরবর্তীতে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানের নামে হামলা করা হয়েছে আফগানিস্থান ও ইরাকে।
সন্ত্রাসবাদের সাথে পরবর্তীতে আরেকটি টার্ম যুক্ত হয় ‘জঙ্গিবাদ’। এই সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনের নামে সিরিয়া, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে আক্রমণ, যুদ্ধমান অবস্থা ও সংকট তৈরির পেছনে মূলতঃ নাইন ইলেভেন ট্রাজেডিই প্রেক্ষাপট হিসেবে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে ‘আইএস’ নামক তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠিকে প্রতিরোধের নামে বিভিন্ন মুসলিম দেশে অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জিঁইয়ে রাখা হচ্ছে। তথাকথিত এই ইসলামী জঙ্গিবাদ ইস্যুকে পূঁজি করে খোদ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে কৌশলগতভাবে ইসলামের বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করানো হয়েছে। মুসলিম জাতিসত্বার চিন্তা চেতনা ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির আমুল পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ব দরবারে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদেরকে একটি ‘কমন এনিমি’ হিসেবে উপস্থাপন করতে তারা পুরোপুরিই সফল।
বিশ্বের মানুষ ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও গণহত্যার জন্য আমেরিকাকেই দায়ী করছে। বুশ কিংবা বারাক ওবামা অথবা ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইসরাইলি আগ্রাসন প্রশ্নে তাদের নীতি এক ও অভিন্ন। যে কারণে সকলের সব রোষের শিকার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিনীরাই। কিন্তু অন্তরালের নাটের গুরু ইহুদিবাদীরা থেকে যাচ্ছে নির্দোষ, নিষ্কলূষ। এরকম একটা বিশ্ব ব্যবস্থা জুইসরা চাচ্ছে এবং তা কার্যকরও করছে। অথচ দেখানো হচ্ছে, এ চাওয়াটা মার্কিনিদের।
মার্কিনিরা তাদের ফাউন্ডারদের দেখানো পথ থেকে; তাদের প্রতিষ্ঠিত উদার গণতন্ত্র ও বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনের স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। ফলে মার্কিনি গণতন্ত্র সাধারণ আমেরিকানদের দোরগোড়া থেকে ইহুদিবাদী বিলিয়নারদের ড্রয়িং রুমে চলে গেছে। টমাস জেফারসনের বিখ্যাত একটা উক্তি হলো- ‘ঈশ্বরের শপথ, মানব মনের উপর সকল পীড়নের বিরুদ্ধে আমার চিরন্তন সংগ্রাম।’ অথচ আজ টমাস জেফারসনের সেই আমেরিকা মানব মনের উপর উৎপীড়ন চালানোর সংগ্রামে বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আব্রাহাম লিংকন, যিনি গণতন্ত্রের স্রষ্টা, বলেছিলেন, ‘যেহেতু আমি কৃতদাস হতে চাই না, সে কারণে আমি মনিবও হতে চাই না। গণতন্ত্র সম্পর্কে এটাই আমার ধারণার প্রকাশ।’ কিন্তু আজকের বাস্থবতা হলো, গণতন্ত্রের ঝান্ডাবাহী আমেরিকাই আজ বিশ্বের মনিব হয়ে দাঁড়িয়েছে আর থার্ড ওয়ার্ল্ড তথা তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল, উন্নয়নশীল দেশ এবং সে দেশগুলোর মানুষ তার গোলামে পরিণত হয়েছে। যে আমেরিকার ফাউন্ডাররা পৃথিবীর জাতিসমূহের সার্বভৌম মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা এবং জাতিসমূহের সমতা ও সহযোগিতা ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন তারা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি যে তাদের প্রিয় আমেরিকাই জাতি সমূহের সাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের নেতৃত্ব দেবে। যে বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনে জাতিসংঘ হওয়ার কথা ছিল সত্যিকারার্থে ‘অ্যাসোসিয়েশন অব স্টেটস’, সেই জাতিসংঘ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে জাতিসমূহের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরশক্তি ইত্যাদি ধ্বংসের বরকন্দাজ হিসেবে কাজ করছে। আর তার মূলে আমেরিকার মাথায় জেঁকে বসা জুইসরাই এ সবের কলকাঠি নাড়ছে।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম মিল্লাতকেই ঐকবদ্ধ হতে হবে। মুসলিম বিশ্বকে একই প্লাটফরমে এসে কার্যকর কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এটা শুধু মানবাধিকার কিংবা ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকারের প্রশ্ন নয়, জেরুজালেম মুসলিম জাতির ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ভাবাবেগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ওখানেই অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কিবলা পবিত্র ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ বা ‘মসজিদুল আক্বসা’। এই পবিত্র শহর জেরুজালেম কখনও ইহুদিদের দখলে ছিল, কখনও খ্রিস্টানদের দখলে, কখনও মুসলমানদের হাতে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মুসলমানরা যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে কিংবা ঔপনিবেশ বসিয়ে এ শহর দখল করেনি; ইসলামের আদর্শ জয় করে নিয়েছিল জেরুজালেমের অধিবাসীদেরকে। জেরুজালেমের সে সময়ের অধিবাসীগণ ইসলামের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছিলেন এবং শহরের শাসন ক্ষমতা ইসলামী খেলাফতের হাতে অর্পণ করেছিলেন। এই ভূমির পুনরুদ্ধারের জন্যই সুলতান ‘গাজী সালাহউদ্দিন আয়ুবী’ জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যায় করেছেন এবং ‘ক্রুসেড’ যুদ্ধ জয় করে এ পবিত্র ভূমিকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত মুসলিমদের এই ভূমি এবং পবিত্র ‘আকসা’ আজ ইহুদিবাদীদের দখলে। তাই আজ ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্বের জন্য, ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকারের জন্য, সর্বোপরি এই পবিত্র শহর ‘জেরুসালেম’, পবিত্র ঘর ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’কে মুক্ত করার জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। জোরালো কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে। অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন আদায় করে নিতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন