গতকাল দেশের ২ কোটি ২০ লাখ শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কর্মসূচী ছিল। ক’দিন আগে হঠাতই এ কর্মসূচী স্থগিত করা হয়। জানা যায়, ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মী ও কর্মকর্তারা ক্যাপসুলের মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে অভিযোগ জানালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ত্বরিৎ কর্মসূচী স্থগিতের ঘোষণা প্রদান করে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মী ও কর্মকর্তাদের এই সচেনতা ও দ্রুত অভিযোগ পেশের ঘটনাকে আমরা তাদের উচ্চ পেশাগত দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক বলে মনে করি এবং এজন্য তাদের অভিনন্দন জানাই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও কর্মসূচী স্থগিত করার যথোচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ধন্যবাদার্হ হয়েছে। না হলে এই ২ কোটি ২০ লাখ শিশুর ভাগ্যে কি ঘটতো, বলা যায় না। হিতে বিপরীত হওয়ার আশংকাই এক্ষেত্রে প্রবল। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯৪ সাল থেকে শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কর্মসূচী চালু রয়েছে। সরকারিভাবে নেওয়া এ কর্মসূচীতে বছরে দু’বার শিশুদের এই ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। বিশ্বের আর কোনো দেশে এ ধরনের কর্মসূচী নেই, যেখানে একসঙ্গে এত শিশুকে ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। একে সরকারের একটি সফল উদ্যোগ হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এর সুফলও প্রমাণিত। মূলত : রাতকানা রোগ থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্যই ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। চিকিৎসাবিদদের মতে, রাতকানা রোগ ছাড়াও ‘এ’ ক্যাপসুলের আরো উপকারিতা রয়েছে। এটা শিশুর দৈহিক বৃদ্ধিতে সহয়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়ায়। এহেন ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা দু:খজনকই শুধু নয়, উদ্বেগজনকও বটে।
বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটিদ্বয়ের রিপোর্ট থেকে, আশা করা যায়, ক্যাপসুলের মান সম্পর্কে পুরো তথ্য পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যেই অভিযোগ পাওয়া গেছে, ভারতের একটি অখ্যাত কোম্পানির কাছ থেকে নিম্নমানের লাল রঙের ‘এ’ ক্যাপসুল কেনা হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মোহাম্মদ মোরাদ জানিয়েছেন, মামলা করে ভারতীয় একটি অখ্যাত কোম্পানির কাছ থেকে নিম্নমানের এই ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল কিনতে সরকারকে বাধ্য করা হয়েছে। সরবরাহ করা এসব ক্যাপসুল কৌটার সঙ্গে লেগে আছে। তিনি আরো জানিয়েছেন, দেশী কোম্পানির সরবরাহ করা সবুজ রঙের ক্যাপসুলে কোনো সমস্যা নেই। বলে রাখা দরকার, ৬ থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুদের সবুজ এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের লাল রঙের ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, ‘এ’ ক্যাপসুল কেনার কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। প্রথমে একটি দেশী কোম্পানি এই ক্যাপসুল সরবরাহের কার্যাদেশ পায়। কিন্তু ওই কার্যাদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যায় ‘অ্যাজটেক’ নামের ভারতীয় একটি কোম্পানী। আদালত ওই ভারতীয় কোম্পানিকে সরবরাহের কাজ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। সেই থেকে লাল রঙের ‘এ’ ক্যাপসুল ওই কোম্পানিই সরবরাহ করে আসছে। পর্যবেক্ষক ও অভিজ্ঞ মহলের প্রশ্ন: শিশুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ‘এ’ ক্যাপসুল ভারতের অখ্যাত কোম্পানীর কাছ থেকে আনতে হবে কেন? দেশে কি তা তৈরি করার কোম্পানির অভাব ঘটেছে? কে না জানে, দেশে বেক্সিমকো, ইনসেপটা, স্কয়ারসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এসব ওষুধ কোম্পানির বিভিন্ন ওষুধ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার নানান দেশে রফতানি হচ্ছে। ক্রমাগতই ওষুধ রফতানি বাড়ছে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বড় কৃতিত্ব হলো, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই শিল্প দেশের ওষুধের চাহিদার প্রায় পুরোটাই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে রফতানির সামর্থ ও যোগ্যতাও অর্জন করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিক দিয়ে গার্মেন্ট শিল্পের পরে ওষুধ শিল্পের সম্ভাবনা সবচেয়ে উজ্জল বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে। পক্ষান্তরে ভারতের ওষুধশিল্প কোনো দিক দিয়েই বাংলাদেশের মতো উন্নত নয়। বেশিরভাগ ওষুধের মানও বাংলাদেশের ওষুধের সমমানের নয়। এই যখন প্রকৃত বাস্তবতা, তখন ভারত থেকে ওষুধ আমদানি করতে হবে কেন? আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্পন্ন নয়, এমন ওষুধই বা আনতে হবে কেন?
এই প্রশ্নের সদুত্তর যেমন খুঁজতে হবে, তেমনি লাল রঙের ‘এ’ ক্যাপসুল আমদানির পেছনের কারণ ও প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করতে হবে। দেশের তৈরি সবুজ রঙের ‘এ’ ক্যাপসুলের মান নিয়ে যেহেতু কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, কাজেই মানসম্পন্ন লাল রঙের ক্যাপসুলও এখানে তৈরি হতে পারে। সেটাই করতে হবে। খ্যাতিমান কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে সব ধরনের ‘এ’ ক্যাপসুল তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এই সঙ্গে কেবল ভারত নয়, অন্য কোনো দেশ থেকেও দেশে উৎপাদিত হয় এমন কোনো ওষুধ আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। আর ভারতীয় কোম্পানির কাছ থেকে ‘এ’ ক্যাপসুল আমদানির ব্যাপারে যাদের সংযুক্ততা ও দায় প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে যথোচিত আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে এবং অবিলম্বে আমদানি বহিত করতে হবে। এটা ঠিক, ‘এ’ ক্যাপসুলের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। আস্থার অভাব দেখা দিতে পারে। এই বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যতদ্রুত সম্ভব স্থগিত কর্মসূচী চালু করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন