সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নীরব-অশান্তিপূর্ণ নির্বাচন : সেনা মোতায়েন ছিল মনস্তাত্ত্বিক ছলনা

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

এই কলামের শুরুতেই সহমর্মিতা, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সারা বাংলাদেশের কোটি কোটি ভোটারের প্রতি, যারা ভোট দেয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন, এ জন্য চেষ্টা করেছেন, দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছেন, দেয়ার জন্য ভোটকক্ষ বা বুথে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন এবং নিজের পছন্দের মার্কায় সিল দিয়ে কাগজটি ভাঁজ করে বাক্সে ফেলতে চেষ্টা করেছেন- কিন্তু পারেননি। সবিশেষ সহমর্মিতা, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি চট্টগ্রাম-৫ আসন তথা হাটহাজারী উপজেলা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ও ২ নম্বর ওয়ার্ড তথা দক্ষিণ পাহাড়তলী ও জালালাবাদের জনগণের প্রতি; একই কারণে, অর্থাৎ তারা আগের রাত থেকেই ভোটকেন্দ্রের ওপর নজর রেখেছিলেন, তারা সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়ে ভোটকেন্দ্রের দিকে আসতে চেয়েছিলেন, তারা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন, তারা ভোটকক্ষে ঢুকে ভোট দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু কোনোটাই পারেননি। কেন পারেননি, এর কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা আজকের কলামে আছে। মোটামুটি বা সাময়িকভাবে হলেও মতপার্থক্য ভুলে হাটহাজারীর তৃণমূল বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল; তাদের প্রত্যয় ও উদ্দীপনা অন্য অনেক আসনের জন্যই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমি চট্টগ্রাম-৫ আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তাদেরকে পরিচালনাকারী নেতৃত্বের প্রতি কৃতজ্ঞ; সেখানকার সম্মানিত আলেম-ওলামার প্রতি ও তাদের হাজার হাজার অনুসারীর প্রতি কৃতজ্ঞ।
ইতোপূর্বে প্রকাশিত ‘নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গ-১ ও ২’ শীর্ষক দু’টি কলামে যে আশঙ্কাগুলোর কথা লিখেছিলাম, তা সত্যি হয়েছে। জাতিকে বোকা বানানো হয়েছে; আবার আমাদেরই কেউ কেউ এই বোকা বানানোর প্রক্রিয়া বা বিষয়টি না বুঝেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এটা দুঃখজনক। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের জুন মাসের সংসদ নির্বাচন বা ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের সংসদ নির্বাচনকালে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে সমন্বয়ের জন্য। এবার ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে এইরূপ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। (রাজনৈতিকভাবে আমার সমমনা) অনেকেই এ কথাটি বোঝেননি, সেটা আমি বলব না (কারণ সেটি অসৌজন্যমূলক হতে পারে); বরং বলব, অনেককেই এ কথাটি আমি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। বোঝার বা বোঝানোর সুযোগ ছিল কি না এটাও একটা প্রশ্ন।
কোনো কলাম লেখকই সবজান্তা তথা সর্ববিষয়ে বিজ্ঞ নন; না হওয়াই স্বাভাবিক। আমিও একই পর্যায়ে পড়ি, সব বিষয়ে কোনোমতেই সমানভাবে সচেতন বা অবহিত বা জ্ঞানসমৃদ্ধ নই। কিন্তু জনপ্রিয় বা আকর্ষণীয় একটি ছন্দময় প্রবাদবাক্য যদি মনে রাখি, তাহলে মনে হয় আমরা উপকৃত হবো। ছাত্রাবস্থায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় ভাবস¤প্রসারণের জন্য এ দু’টি লাইনের মুখোমুখি হয়েছি অনেকবার। লাইন দু’টি হলো : ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।’ এই প্রবাদবাক্যের এ ক্ষেত্রে অর্থ হলো, শুধু কলামটি পড়লে তো হবে না, এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। চিন্তা করার পর মনে মনে বলতে হবে যেটা পড়লাম সেটা ভালো না মন্দ; যেটা পড়লাম সেটা উপকারী না অপকারী; যেটা পড়লাম সেটা কাজে লাগবে না কাজে লাগবে না? ওই সুবাদেই বলছি, যাদের চিন্তার খোরাক হিসেবে কষ্ট করে কলাম লেখকেরা বিভিন্ন কলাম লেখেন, সংশ্লিষ্ট পাঠক যদি খোরাক হিসেবে বিবেচনা করা তো দূরের কথা, এসব লেখাকে ধর্তব্যের মধ্যেই না নেন, তাহলে আফসোস করাও একটা অপচয়।
আমাদেরকে বিগত সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুটো কাজ করতে হবে। একটি কাজের নাম সমালোচনা এবং আরেকটি হলো, আত্মসমালোচনা। সমালোচনা করা সহজ এবং তা অব্যাহতভাবে ধরে চলছে, আগামীতেও চলবে এবং আমিও এতে যোগ দিলাম। আত্মসমালোচনা করা কঠিন, সাহস করে বেশি কেউ করছেন না। আমি করব, তবে আজ নয়। দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট না করলে নির্বাচনমুখী জনগোষ্ঠীর চিন্তার খোরাক পরিষ্কার হবে না বলে আমি মনে করি। কথাগুলো বলছি এ জন্য যে, এবারের সংসদ নির্বাচনে বড় বড় ছলনার ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্তি¡ক ছলনা ছিল নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে। এ কলামের প্রথম দিকেই সেনাবাহিনীর কথা আলোচনায় আনলাম। কারণ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যারা ভোট দিতে পারেননি, তাদের মনে এ প্রশ্নটিই ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়েছিল সত্য; কিন্তু আমরা সাধারণ জনগণ তো তার উপকার পেলাম কই? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যই এই আলোচনার অবতারণা করেছি।
সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, সার্বিকভাবে সিআরপিসির আওতায়, ‘ডিউটিজ ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার’- এই থিওরি বা তত্তে্বর প্রেক্ষাপটে। সিভিল পাওয়ার মানে বেসামরিক প্রশাসন বা বেসামরিক কর্তৃপক্ষ। এই থিওরি বা তত্তে¡র সারমর্ম হলো, এমন কোনো আইনশৃঙ্খলাজনিত বা জননিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির যদি উদ্ভব হয়, যেখানে সাধারণ মানুষের জান ও মাল বা সরকারের সম্পত্তি অথবা শান্তিশৃঙ্খলার পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন এবং যে পরিস্থিতি বেসামরিক কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে সামাল দিতে পারছে না, ওই রূপ ক্ষেত্রে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ডাকা যাবে এবং সামরিক বাহিনী সাহায্য করবে। ‘বেসামরিক কর্তৃপক্ষ’ মানে বেসামরিক প্রশাসন যথা জেলার ক্ষেত্রে জেলার ডিসি বা জেলা প্রশাসক অথবা উপজেলার ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী অফিসার। তারা হলেন বেসামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতিভূ। আমরা চারটি বিষয়ের উল্লেখ পেলাম। প্রথম পেলাম : ‘একটি পরিস্থিতি’। দ্বিতীয় পেলাম : ‘বেসামরিক কর্তৃপক্ষ’। তৃতীয় পেলাম : ‘সামরিক বাহিনীকে ডাকা’। চতুর্থ পেলাম : ‘সামরিক বাহিনীর সাহায্য’। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হওয়ার কথা ছিল এবং কী হয়েছে- এ দু’টির মধ্যে কি কোনো তফাত আছে? থাকলে, সেই তফাতটা কী এবং কতটুকু?
সাধারণ মানুষ মনে করেছিল এক। তবে বাস্তবে হয়েছে আরেক। সাধারণ মানুষ, অন্ততপক্ষে জাতীয়তাবাদী ঘরানার বা ২০ দলীয় ঘরানার বা ঐক্যফ্রন্ট ঘরানার মানুষ মনে করেছিল, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। প্রশ্ন হলো, কোন পরিস্থিতির উন্নতি হবে?: উত্তর : ওই পরিস্থিতি যেখানে দিবারাত্র পুলিশের পেট্রোল কারণে-অকারণে গ্রামগঞ্জে গিয়ে মানুষকে হয়রানি করছিল, মানুষকে থানায় ডেকে আনছিল, গ্রেফতার করছিল, কাউকে ছেড়ে দিচ্ছিল, কাউকে চালান দিচ্ছিল এবং পুলিশের সাথে সরকারি দলের শক্তিশালী তরুণেরা প্রায়ই যেত। ওই পরিস্থিতি যেখানে মানুষ পুলিশের ভয়ে, মামলার বা হামলার ভয়ে বাড়িঘরে থাকত না এবং অন্যের বাড়িতে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে, দূরবর্তী কোনো গ্রামে বা নিকটস্থ শহরের কোনো বাড়িতে বা মেসে থাকতে বাধ্য হচ্ছিল। মানুষ মনে করেছিল, সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে টহল দেবে, পুলিশের হয়রানি বন্ধ হবে; মানুষ কয়েকটি রাত বাড়িতে ঘুমাতে পারবে এবং নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবে এবং ভোটের দিন ভোট দিতে যেতে পারবে। সরকারপক্ষ পরিস্থিতির এরূপ মূল্যায়ন তথা এসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষভাবে অস্বীকার করেন; অস্বীকার করেই যাচ্ছেন। তাদের মতে, কোনো প্রকার পুলিশি হয়রানি হতো না এবং হয়ওনি। তাদের মতে, পুলিশ নিয়মিত টহল দিত, তারা অপরাধীকে খুঁজে বেড়াত, পুলিশ মামলার আসামিকে খুঁজে বেড়াত এবং গ্রামগঞ্জে সর্বত্র শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই ঘন ঘন বিভিন্ন গ্রামে উপস্থিত হতো।
সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলো ঠিকই। প্রথমে শুনেছিলাম ১৫-১৬ ডিসেম্বরের দিকে মোতায়েন করা হবে। পরে শুনলাম ২০-২১ ডিসেম্বরের দিকে সেনা মোতায়েন হবে। আরো পরে শুনলাম ২৪-২৫ ডিসেম্বর মোতায়েন হবে। বাস্তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ২৪ ডিসেম্বর সেনাসদস্যরা অবস্থান নেন এবং ২৫ তারিখ থেকে এলাকা চেনা শুরু করেন। বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী হলো ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’। ‘স্ট্রাইক’ মানে আঘাত করা এবং ফোর্স মানে শক্তি বা বাহিনী অথবা বাহিনীর অংশ। প্রশ্ন হলো, কোথায় স্ট্রাইক করবে? দু-একটি অনুচ্ছেদ ওপরে গেলেই ওই আলোচনা পাওয়া যাবে।
এমন কোনো পরিস্থিতি যদি সৃষ্টি হয় যেটা বেসামরিক প্রশাসন সামলাতে পারছে না, তাহলেই সেনাবাহিনীর ভূমিকা থাকবে, মানে ‘স্ট্রাইক করবে’। অর্থাৎ, যদি সব পরিস্থিতি এমনই হয় যেগুলো বেসামরিক প্রশাসন সামলাতে পারছে, তাহলে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকার সুযোগ নেই। সেনাবাহিনীকে বলা হয়েছিল, যদি কোনো ম্যাজিস্ট্রেট আহ্বান করেন এবং বেসামাল পরিস্থিতিকে সামলানোর জন্য সেনাবাহিনীকে ডাকেন, তাহলে যেন সেনাবাহিনী ওই আহ্বানে সাড়া দেয়। একান্তই ‘যদি’ ডাক পড়ে, তাহলে যেন অকুস্থলে বা ঘটনাস্থলে যাওয়ার রাস্তাঘাট চেনা থাকে, সে জন্যই সেনাবাহিনী টহল দলগুলো হয় মানচিত্র দেখে জায়গাটা চিনে নেয় অথবা সশরীরে গাড়িতে টহল (ইংরেজি সামরিক পরিভাষায় পেট্রোলিং) দিয়ে রাস্তাঘাট চিনে নেয়। এখন প্রশ্ন হলো, একটি উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট কয়জন? যে ক’জনই থাকুন না কেন, নির্বাচনকালে সরকার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট সরবরাহ করে থাকে। উপজেলায় সর্বোচ্চ ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। বাংলাদেশের বেশির ভাগ উপজেলাতেই সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিযুক্ত হয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে ফিরে যাই। জ্যেষ্ঠতম ম্যাজিস্ট্রেট (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) বা অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেট সেনাবাহিনীর কোনো দলকে কেন ডাকবেন? যদি পরিস্থিতি বেসামাল হয়, তাহলেই তো ম্যাজিস্ট্রেট ডাকবেন। এখন সম্মানিত পাঠকদের কাছে প্রশ্ন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি এতই নাজুক ছিল? ভোটের আগের রাত বা ভোটের দিন এমন কোনো এলাকা আছে যেখানে মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে পুলিশের বা বিজিবির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে? ওইরূপ সংঘর্ষ হলে এবং সে পরিস্থিতি পুলিশ বা বিজিবি সামাল দিতে না পারলে তাহলেই সেনাবাহিনীকে ডাকা হবে। কিন্তু এই রূপ পরিস্থিতি বাংলাদেশের কোথাও হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না, বাস্তবে কোথাও হয়ওনি। সেনাবাহিনীর তো দোষ নেই। যে দায়িত্ব তাদের দেয়া হয়েছে, তারা সেগুলো ভালোভাবে পালন করেছে। তারা ছিল ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের ডাকের অপেক্ষায়; দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই ডাক আসেনি। ৯ মাস দীর্ঘ, রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের মনের আকুতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল- এটা জানতাম, জানি এবং এটাই জানব। কিন্তু তাদের চেইন অব কমান্ড তথা রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক তাদেরকে জনগণের খেদমতে না লাগানো হলে সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকেরা কী করতে পারেন!
নির্বাচনের দু-তিন মাস আগে থেকেই জাতিকে বলা হচ্ছিল, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে এবং পৃথিবীকে সাক্ষী রাখা হচ্ছিল যে, সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে। বাস্তবেও তাদের মোতায়েন করা হয়েছে। পৃথিবীকে বলা হচ্ছে এবং বলা হতেই থাকবে যে, সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়েছিল। অতএব, কেউ যদি বলেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে; এটা তার দৃষ্টিতে ‘শান্তিপূর্ণ’। কারণ, সেনাবাহিনীর কোনো কন্টিনজেন্ট বা কোনো দল বা কোনো পেট্রোল পার্টি বা কোনো টহল দলকে কোনো অশান্তিপূর্ণ পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়নি। কারণ, ২৯ ডিসেম্বরের সন্ধ্যার পর তো কোথাও কোনো প্রকাশ্য মারামারি, কাটাকাটি বা গণ্ডগোল ছিল না; যা হওয়ার নীরবে হয়েছে। সেনাবাহিনীর দলগুলো নিজেদের ক্যাম্পে ছিল। সারা রাত যে কী ঘটেছে, সেটা তাদের চোখে দেখার কথা নয়। তাদের কোনো দোষ নেই।
নির্বাচনের তারিখ ছিল ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮। নির্বাচন ‘শুরু হয়ে গেল’ ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার পরপর। কী আশ্চর্য! কী নীরব আক্রমণ! সরকারকে অভিনন্দন জানাতেই হবে; প্রশাসনকে অভিনন্দন জানাতেই হবে নিখুঁত, নিপুণভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য (ইংরেজি পরিভাষায় : এ স্মার্ট প্ল্যান, স্মার্টলি এক্সিকিউটেড)। যতটুকু বুঝতে পারছি, অভিজ্ঞ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তত্তাবধানে এই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কী ছিল? নির্বাচনের চার দিন আগে থেকে নিবিড়ভাবে পুলিশ ও বিজিবি পেট্রোলিং হবে, যেন বিএনপি বা ধানের শীষপন্থী মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। নির্বাচনের আগের দিন, অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ সন্ধ্যার পরপরই চিহ্নিত বা স্থিরকৃত ভোটকেন্দ্রগুলো দখল করা হবে। কে দখল করবে? সরকারপন্থী লোকেরা। তাদের কে নেতৃত্ব দেবেন? স্থানীয় বিশ্বস্ত ইউপি চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্য বা কাউন্সিলর বা সাবেক চেয়ারম্যান-সদস্য-কাউন্সিলর বা সরকারি দলের বা এর অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ তেজী নেতা, সম্মানিত ব্যক্তি প্রমুখ, যারা এলাকা এবং এলাকার মানুষকে নিবিড়ভাবে চেনেন। তাদেরকে কে সাহায্য করবে? বিজিবি বা পুলিশ !! বিজিবি বা পুলিশের সাহায্য পরোক্ষ। সেটা কীভাবে? একান্ত প্রয়োজন হলে কেন্দ্রে ঢোকো, তা না হলে কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়াও অথবা কেন্দ্র থেকে ৫০ বা ১০০ মিটার দূরে দাঁড়াও; তাহলে ওই টহল দলের ভয়ে বিএনপিপন্থী মানুষ কেন্দ্রের কাছে আসবে না। সেই সুযোগে সরকারি লোকেরা কেন্দ্রে ঢুকবেন, ব্যালট পেপারে সিল দেবেন, সিল দেয়া ব্যালট পেপার দিয়ে বাক্স ভরবেন। যখন কাজ শেষ, তখন কিছু লোককে রেখে বাকিরা চলে যাও। এ পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব কি সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত ছিল? আমার জানা মতে, তথা পর্যবেক্ষণ মতে তথা আমার মূল্যায়নে প্রশ্নটির উত্তর হলো: সেনাবাহিনীর ওপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল না। ন্যস্ত থাকলে আসনভিত্তিক মোতায়েন করা সেনাবাহিনী একই এলাকায় নির্বাচনের নিমিত্তে মোতায়েনকৃত সব বিজিবি-পুলিশের মুভমেন্ট বা চলাচল সমন্বয় করত, কে কোথায় যাচ্ছে সেটা জানত। সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্ট বা সেনাদল নিশ্চয়ই ওই গুরুত্বপূর্ণ রাতে এক জায়গায় স্থিতিশীল থাকত না বা বিশ্রামে থাকত না।
গত ৩০ ডিসেম্বর সকালে সূর্য উঠল, মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রের দিকে আসা শুরু করল। মানুষকে বাছাই করা শুরু হলো। যারা ‘ধানের শীষপন্থী’ বলে চিহ্নিত, তাদেরকে ঢুকতে দেয়া হলো না; অগত্যা কেউ ঢুকতে পারলেও বা কাউকে ঢুকতে দেয়া হলেও তাদের বেশির ভাগই নিজের ইচ্ছামতো ভোট দিতে পারেননি। ক্রিকেট খেলায় আছে টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে ইত্যাদি। যে ক্রিকেট ম্যাচটি দিনের আলোতে শুরু হয়ে রাতের অন্ধকারে ফ্লাড লাইটেও চলে, সেটিকে বলা হয় ডে-নাইট খেলা। এবারের নির্বাচনটি ছিল সে রকম নাইট-ডে বা নাইট অ্যান্ড ডে। ২৯ তারিখ শুরু হয়ে ৩০ তারিখ শেষ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের বা ভোট বাক্সগুলোর বা ব্যালট পেপারগুলোর ‘কুমারিত্ব’ (বা কৌমার্য মানে সতীত্ব, ইংরেজি পরিভাষায় ভার্জিনিটি) নষ্ট হয়েছে আগের রাতেই। ৩০ তারিখ দিনের শুরুতে দেশের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রের বা ভোট বাক্সের বা ব্যালট পেপারের কোনো নিরঙ্কুশ পবিত্রতা ছিল না। যেহেতু রাতের বেলা ভোটকেন্দ্র দখল ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই করেছেন, যেহেতু সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে বহু ক্ষেত্রেই এই কর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বলে হাজার হাজার কেন্দ্রের চার পাশের লাখ লাখ মানুষ মৌখিকভাবে বা মিডিয়া বা সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীকে জানাচ্ছেন। সুতরাং ওইখানে অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। তাই সরকার বলতেই পারে যে, নির্বাচন ‘শান্তিপূর্ণ’ ছিল। সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্ট বা সেনাদল তো নিজেদের ক্যাম্পে ছিল; ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়গণ নিজেদের বাড়িতে বা আবাসস্থলে বা অফিসেই ছিলেন- তারা তো রাতের ঘটনার সাক্ষী নন। এ ক্ষেত্রে সাধারণ নিরস্ত্র, নিরীহ জনগণের বা ভোটারদের কী করণীয়? একজন প্রার্থীরই বা কী করণীয়? কোন কোন আসনে কী কী হয়েছে, সেটা আমি হুবহু এখানে লিখতে পারছি না। একটা সাধারণ বা গড়পড়তা চিত্র তুলে ধরলাম।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পাটি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (11)
Hazi Salim Sarker ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৩ এএম says : 2
ক্ষমতাসীনগন আজ যা শিখাবে , আগামীকাল তা-ই ফেরত পাবে । ব্যবধান শুধু সময়ের ।
Total Reply(0)
Ahsan Habeeb ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৪ এএম says : 1
এরা সাধারন মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আর এই বাহিনী এখন একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কিছু অফিসার বড় বাড়ি দামি গাড়ি নিয়ে আরামে জীবন যাপন করলেও সর্বোপরী বাহিনীর ব্যাপক সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে।
Total Reply(0)
Tariqul Islam ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৪ এএম says : 2
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের দেশপ্রেমিক গর্বিত বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে
Total Reply(0)
মোঃজাফর ইকবাল ভূঁইয়া ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৪ এএম says : 2
বিভিন্ন সংস্হা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ব বলছে আর সরকার অ'স্বীকার করছে, কিন্ত অভিযোগ গুলোকে চ্যালেন্জ করারর সাহস দেখাচ্ছেনা কেন?
Total Reply(0)
Abdullah Md Kadir ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৫ এএম says : 2
এই চলনার ও বিচার হবে বাংলার মাটিতে।
Total Reply(0)
Mizan Rahman ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৫ এএম says : 1
দেশের জনগনকে বোকা বানানো হয়েছিল
Total Reply(0)
Mir Irfan Hossain ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৫ এএম says : 5
সেনাপতিরা সব আমলে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
Total Reply(0)
Khaled Hossain ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৬ এএম says : 0
আমাদের সেনাবাহিনী ছিল আমাদের গৌরব,বর্তমানে সেটা কারো হুকুমের গোলাম হয়ে গেছে,যদি জনগনের কল্যাণই না করতে পারে তবে নির্বাচনে মাঠে থাকার কি দরকা ছিল?সারাবিশ্ব দেখেছে এই পাতানো নির্বাচন, তাতে কি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি???
Total Reply(0)
Mohammed Shiful Islam ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৬ এএম says : 0
আই ওয়াশ!
Total Reply(0)
Maftoon Ahmed Khan Rubel ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৬ এএম says : 0
এতে আল্টিমেটলি দেশের সার্বোভৌত্বের ক্ষতি করা হয়েছে,,,, কারন দেশের সেনাবাহিনী গনমানুষের সর্বশেষ ভরসাস্থল,,, মানুষ চিন্তিত ও আতংকিত,,,,
Total Reply(0)
Zulfiqar Ahmed ২১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১:১৭ এএম says : 0
সেনাবাহিনীকে অযথা দোষারপ করা ঠিক নয়। তাদেরকে তো কোনো পাওয়ার দেয়া হয়নি। তো কি করবে। তারা তো হুকুমের গোলাম।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন