ধর্ষণ এবং গণধর্ষণ কি আমাদের দেশে সমাজ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হলো? যেভাবে প্রায় প্রতিদিন গণধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো দেখে এবং শুনে মনে হচ্ছে যে, ধর্ষণ বুঝি বাংলাদেশে সামাজিক জীবনের কালচারে পরিণত হচ্ছে। নির্বাচনে ভোটদানকে কেন্দ্র করে সুবর্ণ চরে যা ঘটেছে সেটিকে পাশবিক বললে কম বলা হবে। বরং বলা যায়, রাজনীতির ছদ্মবেশ ধারণ করে ১০/১২ জন জানোয়ার ৩৬ বছর বয়সী চার সন্তানের মায়ের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে। ১০/১২ জনের পালাক্রমিক ধর্ষণের ফলে ঐ মহিলা হয়তো মরেই যেতেন, তবে আল্লাহর রহমত থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। রবিবার ডেইলি স্টারে দেখলাম ৫টি জেলায় ৫ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই জন নারী এবং তিন জন শিশু। তিন জন শিশুর মধ্যে একজনের বয়স মাত্র ৪ বছর। এসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ফেনী, নোয়াখালী, দিনাজপুরের বিরামপুর, ফরিদপুর এবং বরিশালে। এই ৫ জেলার ৫টি গ্রামের নামও ঐ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি মহিলা এবং শিশুকে এমন পাশবিকভাবে ধর্ষণ করা হয় যে তারা প্রত্যেকে জ্ঞান হারায়।
একই দিন দৈনিক প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে স্বামী-সন্তাদের বেঁধে রেখে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনার রেশ না কাটতেই জেলার কবিরহাটে আরেক গৃহবধূ গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ পরিচয়ে তিন ব্যক্তি গত শুক্রবার দিবাগত রাতে ঘরে ঢুকে তিন সন্তানের ঐ জননীকে (২৯) ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের এক নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত শনিবার সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে এক পাপিষ্ঠ। প্রথম আলোর রিপোর্ট মোতাবেক গত ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৩ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনই শিশু ও কিশোর। নোয়াখালীর কবিরহাটে যে গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়েছে তার স্বামীকে বিএনপির সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে একটি বিস্ফোরক মামলায় কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। আর এই সুযোগে তার স্ত্রীর সম্ভ্রম লুণ্ঠন করা হয়েছে। যারা তাকে ধর্ষণ করেছে তাদের একজনকে তিনি চেনেন। তার নাম জাকের হোসেন। সে যুবলীগ করে। ফরিদপুরে কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। শরিয়তপুর ও বরিশালে দুই স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
এই ধরণের পাশবিক কাহিনী মানুষ প্রতিদিনই খবরের কাগজে পড়ছেন। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ২০১৩ সালে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৬ শ’। ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৬ শ’ ৩৫। ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৯ শ’ ৩০। ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৭ শ’ ২৮। ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৯ শ’ ৯৫ বা ১০ হাজার। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। খুব বেশি দিন আগের কথা না। গ্রামে বা শহরে কোনো ব্যক্তি ধর্ষণ করে জেলে গেছে, একথা জানলে শুধু তাকে উত্তম মধ্যমই দেওয়া হতো না, সমাজের সকলে ঘৃণা করতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এগুলো ডাল-ভাত হয়ে গেছে এবং হিরোইজমের একটি পার্টে পরিণত হয়েছে।
সৌদি আরবে যেনাকারীকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। আমাদের দেশের তথাকথিত প্রগতিবাদীরা এটিকে বর্বরতা বলেন। এই প্রগতিবাদীদের কারো মা বোন বা বউকে যদি ধর্ষণ করা হয় তখন কিন্তু তারা ঠিকই তার মৃত্যু চায়। এই দেশেও ধর্ষণ মুহূর্তের মধ্যে কমিয়ে আনা যায় যদি বিচার করে ধর্ষক বা গণধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক দেখা যায় যে জোর করে কেউ বলাৎকার করলে ধর্ষিতা নারী ছুরি বা চাকু দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ বা অন্ডকোষ কেটে ফেললে সেই ধর্ষক বা তার সহযোগীরা সেই গ্রাম ছেড়েই পালিয়ে যায়।
ধর্ষণের এই সংক্রামক ব্যাধি যদি নির্মূল করতে হয় তাহলে অশ্লীল সিনেমা, অশ্লীল ভিডিও, অশ্লীল স্টিল ছবি, নারীর স্কিন টাইট এবং উত্তেজক পোশাক পরিধান এবং পুরুষ কর্তৃক যুবতী বা অন্য নারীকে উত্যক্ত করা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে হবে। এই সাথে ইংরেজি ও ভারতীয় ছবি, যেগুলো মানুষের আদিম রিপুকে উসকে দেয়, সেগুলো দেখার গেটওয়ে বন্ধ করতে হবে
দুই
এবার আসছি রাজনীতিতে। আবার শুনতে পাচ্ছি সংলাপের গুঞ্জন। এবারও সংলাপের প্রস্তাব প্রথম দিয়েছেন ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন। ইলেকশনের আগেও সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনিই। বিএনপি ৬/৭ বছর ধরে সংলাপের কথা বলেই যাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পাত্তা দেয়নি। কিন্তু যেই মাত্র ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসাবে সংলাপের প্রস্তাব দেন ওমনি সরকার সেই প্রস্তাব লুফে নেয়। দুই দিন ব্যাপী সংলাপ হয়। কিন্তু সরকার একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করেনি। বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট ঐ সংলাপে সরকারকে একটি অনুরোধ জানায়। সেটি হলো, এর পর থেকে রাজনৈতিক কারণে যেনো কোনো বিরোধী দলের নেতা বা কর্মীকে গ্রেফতার না করা হয়। একই সাথে গায়েবি মামলাও বন্ধ করার অনুরোধ করা হয়। সরকারের অনুরোধ মোতাবেক রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের একটি তালিকাও সরকারকে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও গ্রেফতার থামেনি। এরপর চিফ ইলেকশন কমিশনার বলেন যে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করার পর আর কোনো গ্রেফতার করা হবে না। ৮ ডিসেম্বর তফসিল ঘোষিত হয়। তারপর গ্রেফতার থামা তো দূরের কথা, গ্রেফতারের হার আরও বেড়ে যায় এবং সেটি গণগ্রেফতার বা পাইকারী গ্রেফতারে পরিণত হয়। এই গ্রেফতার এবং বিরোধী দলীয় নেতা কর্মীদেরকে তাড়া করা নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তবে এখন দেশের মধ্যে অনেক সংস্থা এবং বিদেশের অনেক নামজাদা পত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশন ভোট ডাকাতির কথা বলছে। তাই দেশের মধ্যেও কেউ কেউ সাহস করে কিছু কিছু সত্য কথা বলেছেন।
নির্বাচনের পর পরই মানুষ ধারণা করেছিলেন যে, যে মাত্রায় ভোট ডাকাতি হয়েছে তার একটি শক্ত প্রতিবাদ দেশব্যাপী হবে। কারণ বিরোধী দল বিশেষ করে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলেছিলেন যে, নির্বাচনকে তারা একটি আন্দোলন হিসেবে নিয়েছেন। আন্দোলন বলতে তারা বার বার বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র ছিনতাই হয়ে গেছে, সেই ছিনতাইকৃত গণতন্ত্র ফেরত এনে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক জনগণের কাছে ফেরত দেওয়া হবে। এটি তো আর ছেলের হাতের মোয়া নয়, যে চাইলেই পাওয়া যায়। এজন্য স্তরে স্তরে ধাপে ধাপে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। তাই ৩০/৩১ ডিসেম্বর বা ১ জানুয়ারি জনগণ ধারণা করেছিলেন যে, দুই চারদিনের মধ্যেই ভোট ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে একটি কঠোর কর্মসূচি আসছে। ইলেকশনের পর ২১ দিন হয়ে গেল। কোনো কঠোর কর্মসূচি তো দূরের কথা, একটি মানব বন্ধন কর্মসূচিও দেওয়া হয়নি। তাহলে কি ৩০ ডিসেম্বরের ইলেকশনকে বিএনপি এবং ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট মেনে নিয়েছে?
অথচ নির্বাচনের পরের দিন এবং তারও দুইদিন পরে ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ দুইটি প্রেস কনফারেন্স করেছেন। দুটি প্রেস কনফারেন্সেই ড. কামাল হোসেন এবং মির্জা ফখরুল উপস্থিত ছিলেন। তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি এই নির্বাচন মেনে নেয়নি। এই নির্বাচনকে তারা প্রত্যাখ্যান করছেন। নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছেন বলেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্টও প্রত্যাখ্যান করছেন। আর সেই পার্লামেন্টের মাধ্যমে গঠিত সরকারকেও তারা অগ্রহণযোগ্য এবং অবৈধ বলে মনে করছেন। আর এসব কারণেই বিএনপির ৬ জন সংসদ সদস্য, গণফোরামের মোকাব্বির খান এবং সুলতান মোহাম্মদ মনসুর শপথ নেননি।
তিন
পত্রপত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক বিএনপি নেতারা এখন কনভিন্সড হয়েছেন যে, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে না। সুতরাং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এই সরকারের অধীনে আগামী কোনো নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না। সামনে অর্থাৎ মার্চ মাসে আছে দুইটি নির্বাচন। একটি উপজেলা নির্বাচন। আর একটি ডাকসু নির্বাচন। এই সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। ডাকসু নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপির সিদ্ধান্ত কী, সেটি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এটুকু বলতে পারি যে, ডাকসুকে দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট বলা হয়। দেশের পার্লামেন্ট দখল করার পর সরকার যে দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট বিরোধী দলের হাতে ছেড়ে দেবে সেটা হিসাবে মেলে না। তাই ডাকসুও তারা দখল করবে বলে আমার মনে হয়। ছাত্রলীগকে ডাকসুর বাইরে রাখা হবে সেটা কল্পনাই করা যায় না।
এখন প্রশ্ন দুটি। এই সরকারের আন্ডারে আর কোনো নির্বাচন করবো না, সেটি হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কয়দিন তারা টিকাতে পারবেন? সরকার এসেছে ৫ বছরের মেয়াদে। ৫ বছর তো কম সময় নয়। এই ৫ বছরে সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়া তো পরের কথা, গণফোরাম থেকে যে দুই ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সেই সুলতান মনসুর এবং মোকাব্বির খানকে কামাল হোসেন সাহেব কতদিন সংসদের বাইরে রাখবেন? এই বিষয়টির ওপরও অসংখ্য মানুষ নজর রাখছেন।
অবাক হয়েছিলাম, যখন ঐক্যফ্রন্টের ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার এবং মহাজোটকেও এই সংলাপে ডাকা হবে, ডাকা হবে না শুধু জামায়াতে ইসলামীকে। এখন দেশের প্রধান সমস্যা কোনটি? জোর করে ৯৬.৭৭ শতাংশ ভোট দখলটিই কি প্রধান সমস্যা নয়? তবে ঐক্যফ্রন্টকে কষ্ট করতে হয়নি। আওয়ামী লীগই আসন্ন সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন বিএনপিকে আত্ম অনুসন্ধান করতে হবে। কেন তারা ৪০ হাজার ১৯৯টি ভোট কেন্দ্র এবং ২ লাখ ৬ হাজার ৫৪০টি ভোট কক্ষের কোনটাতেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো না। জনতার প্রতিরোধ গড়ে তুলে সন্ত্রাসীদের হাতে মার খেয়ে পিছু হটলেও মানুষ বিরোধী দলীয় কর্মীদেরকে সহানুভূতি ও সাহস জোগাতো এবং মাস্তানদেরকে ঘৃণা করতো। সেই ঘৃণা থেকেই গড়ে উঠতো দুর্বার গণআন্দোলন।
journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন