সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আত্মহত্যা ও ধর্ষণ সমাজের নাজুক হালই তুলে ধরছে

| প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

দেশে ধর্ষণ এবং আত্মহত্যার হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন কোনো দিন নেই যে দেশের কোনো না কোনো এলাকায় ধর্ষণ ও আত্মহত্যার ঘটনা না ঘটছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১১ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এ হিসেবে প্রতিদিন গড়ে আত্মহত্যার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩০ জন। এ চিত্র নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। গবেষকরা জাপানের সাথে তুলনা করে বলছেন, এক সময় জাপানে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটত। গত দশ বছরে দেশটিতে এই হার কমেছে। অন্যদিকে গত দশ বছরে বাংলাদেশে এ হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্মহত্যার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, হতাশা, মাদকাসক্তি, সামাজিক-পারিবারিক নিপীড়ন, ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত, একের প্রতি অন্যের আগ্রাসন, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়। অন্যদিকে সামাজিক মূল্যবোধ ও অবক্ষয়ের কারণে ধর্ষণের হার উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৪২টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮২ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৮ জনকে। এছাড়া যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪৬ জন নারী ও শিশু। দেখে শুনে মনে হয়, যেন ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। এ পরিস্থিতিতে সমাজ বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং এ থেকে পরিত্রাণের জন্য পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্বে আত্মহত্যা প্রবণতার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে রয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ১১ থেকে ৬৯ বছর বয়সের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, হতাশা থেকে এ ঘটনার হার বাড়ছে। মেয়েদের মধ্যে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির ঘটনায় আত্মহননের পথ বেশি বেছে নেয়া হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ধর্ষণের অপমান এবং পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়া থেকে ঘটনার শিকার নারী আত্মহত্যার পথে ধাবিত হয়। বিগত বছরগুলোতে ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্বৃত্ত শ্রেণী এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, সঙ্গবদ্ধভাবে গণধর্ষণের পথ বেছে নিচ্ছে এবং হত্যাও করছে। নির্বাচনের পরপর নোয়াখালির সুবর্ণচরে ক্ষমতাসীন দলের নেতার কথা মতো ভোট না দেয়ার কারণে চার সন্তানের জননী এক মহিলা গণধর্ষণের ঘটনা শিকার হন দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। কিছুদিন আগে কবিরহাটেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। এছাড়া কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে আশুলিয়ায় এক গার্মেন্টকর্মী তারই সহকর্মীদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে। ধর্ষণ থেকে শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না। বিকৃত মানসিকতার কিছু মানুষ কর্তৃক শিশু ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অনেক সময় ধর্ষণের পর শিশুটিকে হত্যাও করা হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি ও অগ্রগতি যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি ধর্ষণ এবং যৌনহয়রানির বিষয়টি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিকে নারী উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে এবং নারীর স্বাভাবিক বিচরণের ক্ষেত্রটিকে তাদের জন্য নিরাপদ করা যাচ্ছে না। এজন্য মূলত পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়কে বিশ্লেষকরা দায়ী করছেন। সামাজিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একজন ধর্ষিতার পাশে না দাঁড়িয়ে ধর্ষকের পক্ষে অনেককে অবস্থান নিতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে ধর্ষিতার মধ্যে চরম হতাশার জন্ম নেয় এবং সে তার জীবনকে অর্থহীন মনে করে আত্মহত্যার পথকেই শ্রেয় মনে করে। সামাজিক এই নৈতিক অবক্ষয় এবং প্রশ্রয়ের কারণে দুর্বৃত্তশ্রেণী আরও দুর্বিনীত হয়ে উঠছে। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি এবং যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার কারণেও ধর্ষক পার পেয়ে যায়।
দেশে যেভাবে ধর্ষণের হার বাড়ছে, তাতে নারীদের স্বস্তিতে চলাফেরার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ও অনিরাপদ হয়ে উঠছে। আমরা নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির কথা বলছি, অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতির কথাও বলছি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উন্নতি ও অগ্রগতি কেমন সমাজ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে হচ্ছে? আমরা কি এমন সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে উন্নতি করতে চাই, যেখানে নারী ও শিশু নিরাপদ নয়? পারিবারিক ও সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় বজায় রেখে, এ উন্নতির কি অর্থ হতে পারে? বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অবক্ষয় ঠেকাতে না পারলে, আমাদের সমাজ অসভ্য হয়ে উঠতে খুব বেশি দেরি লাগবে না। নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো অপরাধে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় দ্রুত শাস্তি দিতে না পারলে এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কথা বারবার বলছে। আমরা মনে করি, ধর্ষণের বিরুদ্ধেও সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজের সচেতন নাগরিক ও অভিভাবকদের এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। ধর্মীয় রীতি-নীতি ও নৈতিকতার বিষয়গুলো বেশি বেশি তুলে ধরতে হবে। আত্মহত্যা মহাপাপ এবং এতে কোনো সমাধান নেই-এ বিষয়টি শিক্ষার্থীসহ সকলের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। জীবনে অনেক ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ও দুর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক, আত্মহনন এর সমাধান নয়। বরং বেঁচে থেকে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব-এ বোধ সবার মধ্যে জাগ্রত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। তা নাহলে আমরা যতই অর্থনৈতিক উন্নতি করি না কেন, তা অর্থহীন হতে বাধ্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Hasan ২২ জানুয়ারি, ২০১৯, ৩:৫৯ পিএম says : 0
দেশে ইসলামী শরিয়াহ প্রয়োগই উক্ত অবস্থা পরিবর্তনের ও শান্তিময় জীবনের একমাত্র পথ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন