সমাজে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ নেতৃত্ব দিতে নিজের অর্থ সম্পদ সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যয় করেন। সে কাজটা করে নিজের সম্মান কুড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। কৃত কাজটি ইসলাম সমর্থন করে কিনা তা দৃষ্টিগোচরে ব্যত্যয় ঘটে। আর এর ভালো মন্দ দিক প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অনেক দ্বীনদার ব্যক্তি প্রেরণ করেন। এরই উদাহরণ হিসেবে আলহাজ্ব সূফি আব্দুল কাদের (রহঃ) অন্যতম। ব্রিটিশ শাসনামলে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলহাজ্ব সূফি আব্দুল কাদের (রহঃ)। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত এই সূফি সাহেব পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যবসাকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ধারণ করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর ছিল দারুণ প্রভাব ও প্রতিপত্তি। ব্যবসায়িকভাবে সফল ব্যক্তি হিসেবে নির্মাণ করেন কাদের হল নামক একটি সিনেমা হল। তথাকথিত আধুনিক জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত অভ্যস্ত। কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার ব্যাংক রোডে গড়ে তোলেন মেসার্স মাসুম ওয়েল মিল্স নামক সরিষার তৈল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান; এ প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত সরিষার তৈলের এতদঞ্চলে ব্যাপক প্রসিদ্ধি ছিল। এছাড়া আরও নানাবিধ পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন।
নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার শোল্লা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন আবদুল কাদের। তাঁর পিতার নাম হাজী আতর মিয়া মুন্সী। পিতামহের নাম নিয়াজ আলী। শোল্লা গ্রামের কামালপুর হাই স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি বাবা মায়ের ৪র্থ সন্তান। তারা ০৪ ভাই, ০৬ বোন। সূফি সাহেবের অপর ভাইগণ হলেন; মরহুম ছানাউল্লাহ মিয়া। তিনি বি,এ পাশ করেন। কর্ম জীবনে কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার প্রাণ কেন্দ্রে মেসার্স ছানাউল্লাহ আর্ট প্রেস নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। অপর দু’ভাই আলী আজ্জম মিয়া ও আলহাজ্ব ওবায়দুল কাদের। উনারা বর্তমানে বেঁচে নেই।
সূফি আবদুল কাদের পরিণত বয়সে চাচা হাজী আনা মিয়া মুন্সীর কন্যা রাহাতেন্নেসার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর পুত্র তোফাজ্জল হোসেন। যিনি খুব ছোটকালে ইন্তেকাল করেন। অপর পুত্র মোস্তফা কামাল। কন্যাগণ হলেন: মরহুমা তফুরা খাতুন, স্বামী মরহুম আলী আশ্রাফ পাটোয়ারী, মরহুমা সালেহা খাতুন, স্বামী মো. আব্দুল বারিক, খোদেজা বেগম, স্বামী মরহুম আলী আশ্রাফ পাটোয়ারী।
সুফি সাহেবের আদরের সন্তান মোস্তফা কামাল ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার ¯েœহের লালিত সন্তানকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা নিজ তত্ত¡াবধানে সমাপ্ত করান। তিনি কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার মৌকারা দরবার শরীফ কর্তৃক পরিচালিত মৌকারা মাদরাসা থেকে কামিল পর্যন্ত দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি ছারছীনা দরবার শরীফের পীর হযরত মাওলানা আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ (রহ.) এর নিকট বায়াত হন। মৌকারা দরবার শরীফ ছারছীনা সিলসিলার অনুসারী। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সূফী আব্দুল কাদের সাহেব তাঁর ¯েœহের পুত্র মোস্তফা কামালের সাথে তৎকালীন কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর মহকুমা বর্তমানে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার নরিংপুর গ্রামের এলাহী বক্স পাটোয়ারীর ২য়া কন্যা রোকেয়া বেগম বকুলের সাথে বিবাহের বন্দোবস্ত করেন। সূফি সাহেবের নাতি নাতনি অর্থাৎ মোস্তফা কামালের পুত্র-কন্যাগণের নাম ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হলো। হাফেজ ড. মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ। উম্মে কুলসুম, স্বামী- সাইদুর রহমান, তিনি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) এ কর্মরত। রহিমা বেগম, স্বামী- ইঞ্জিনিয়ার মো. মোস্তফা জামাল ভূঁইয়া, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরিজীবি। জোবেদা বেগম, স্বামী- মাওলানা রেজাউল করিম, আমদানি ও পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। জান্নাতুল ফেরদাউস, স্বামী- এমদাদুল হক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োজিত। মহিব বিল্লাহ। উম্মে সালমা, স্বামী- মইন উদ্দিন বাবু, আমেরিকা প্রবাসী।
সূফি আব্দুল কাদের (রহ.) এর পুত্র মাওলানা মোস্তফা কামাল পিতার ইচ্ছানুযায়ী নিজ সন্তানদের দ্বীনী তথা নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর প্রথম পুত্র হাফেজ ড. মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ। তিনি ১৯৭৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল (৯ই রবিউল আউয়াল) নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার শোল্লা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি চাঁদপুরের মোমিনপুর মাদরাসা থেকে হিফ্যুল কুরআন শিক্ষা সমাপ্ত করেন। বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৯৩ সালের দাখিল ও ১৯৯৫ সালের আলিম পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় মানবিক বিভাগ থেকে যথাক্রমে ১ম ও ৩য় স্থান লাভ করে গৌরব অর্জন করেন। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালেশিয়া থেকে এলএলবি (অনার্স), কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেরিটাইম ল’ এর উপর পিএইচডি গবেষণা সমাপ্ত করেন। বর্তমানে তিনি ওমানের সুলতান কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারি অধ্যাপক পদে নিয়োজিত আছেন। তিনি ২০০৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার শালদানদী গ্রামের কৃতি সন্তান, রাজধানী শহর ঢাকার কল্যাণপুরের বর্তমান অধিবাসী, বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার সাবেক রেজিস্ট্রার, টঙ্গী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, ঢাকা কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ বিশিষ্ট সমাজ সেবক, অধ্যাপক আবুল কালাম এর ৩য় কন্যা তাহমিনা আঞ্জুম’র সাথে ২০০৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন কসবা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী আড়াইবাড়ী গ্রামের কৃতি সন্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু জাফর মোহাম্মদ কুতুবুল ইসলাম নোমানীর ভায়রাভাই। তাঁদের দুই সন্তান তানিশা বিল্লাহ ও তাক্বিয়া বিল্লাহ বাবা মার সাথে ওমানে বসবাস করছে। মাওলানা মোস্তফা কামালের অপর ছেলে মহিব বিল্লাহ ১৯৮৭ সালের ২০ জুলাই কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি দৌলতগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি অর্জনসহ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে লাকসাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র বৃত্তি অর্জন করেন। ইবনে তাইমিয়া হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্সে যথাক্রমে ২য় ও ৫ম স্থান অর্জন করেন। তিনি ২০১২ সালে রংপুর ক্যাডেট কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি সিলেট ক্যাডেট কলেজে কর্মরত আছেন। তিনি ২০১৪ সালে কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার চৌদ্দগ্রাম রোডের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাজী মো. আব্দুস সাত্তারের জ্যেষ্ঠ কন্যা ডা. শাহরিয়া সুলতানা হ্যাপী’র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার সহধর্মিনী ডা. শাহরিয়া সুলতানা হ্যাপী কুমিল্লা জেলাধীন লাকসাম উপজেলা সদরে অবস্থিত লাকসাম মেডিক্যাল সেন্টারে মেডিক্যাল অফিসার পদে কর্মরত আছেন। তাদের মুতাসিম বিল্লাহ আবরার নামে ০১ বছরের একজন পুত্র সন্তান রয়েছে।
ভারত বর্ষের অন্যতম ছিলছিলা ফুরফুরা শরীফের অনুসারী ছারছীনা দরবার শরীফের মরহুম পীর সাহেব হযরত মাওলানা নেছারউদ্দিন (রহঃ) এর অনেক ভক্ত ও অনুসারী এতদঞ্চল থেকে বার্ষিক মাহফিলে যোগদান করতেন। একদা আলহাজ্ব সূফি আব্দুল কাদের (রহঃ) কে পীর সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। আল্লাহু সুবহানাহু তা’আলার প্রিয় বান্দার সাহচর্যে এসে আলহাজ্ব সূফি আব্দুল কাদের (রহঃ)-এর মাঝে আসে অলৌকিক পরিবর্তন। তিনি ছারছীনা দরবার শরীফের পীর হযরত মাওলানা নেছার উদ্দিন (রহ:) এর নিকট বায়াত হন। প্রতিজ্ঞা করলেন বাড়ীতে ফিরেই নিজের হাতে গড়া লাভজনক প্রতিষ্ঠান কাদের হল নামক সিনেমা হলটি হারাম উপার্জনের কারণে ভেঙ্গে ফেলবেন। পীর সাহেবের নসিহত শুনে তিনি আল্লাহ তায়ালার ভয়ে এটিকে চিরতরে অপসারণ করে ফেললেন। নতুন করে শুরু করেন হালাল ব্যবসা। আর নিজেকে নিয়োজিত করেন দ্বীন ইসলাম ও মানবতার খেদমতে। তার সহযোগীদেরকেও হারাম উপার্জনের পথ থেকে বিরত করতে সক্ষম হন।
মরহুমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর উদ্যোগে কুমিল্লা জেলার লাকসামে নির্মিত হয় লাকসাম দৌলতগঞ্জ এতিমখানা। সরকারি অনুদান এবং বিত্তবানদের আর্থিক সহায়তায় বর্তমানে প্রায় ১৫০ জন এতিম নিবাসী এই এতিমখানায় অবস্থান করছে। এছাড়াও নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার অন্তর্গত শোল্লা ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করেন বাবুপুর হাফেজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা। বর্তমানে এখানেও প্রায় ১১০ জন ছাত্র অধ্যয়ন করছে। পাশাপাশি কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলায় অবস্থিত মৌকারা দারুসসুন্নাত কামিল মাদরাসা বর্তমান এ আলোকিত অবস্থানে আসার পেছনে রয়েছে আলহাজ্ব সূফি আব্দুল কাদের (রহঃ)-এর অসামান্য অবদান। কথিত আছে যে, এই মাদরাসার প্রতিটি ইটের সাথে জড়িয়ে আছে সূফি সাহেবের শ্রম। তাঁর ইন্তেকালের পর মরহুমের একমাত্র পুত্র মরহুম আলহাজ্ব মাওলানা মোস্তফা কামাল উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় আমৃত্যু যুক্ত থেকে খেদমত করে গেছেন। তাদের তিরোধানের পর তাদের উত্তরসূরী সূফি সাহেবের নাতি হাফেজ ড. মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ ও মহিব বিল্লাহ উক্ত কাজের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
সূফি সাহেব চলার পথে বিভিন্নভাবে সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। একবার তিনি ট্রেনে ভ্রমণ করে অন্য স্থানে যাচ্ছিলেন। সময় স্বল্পতার কারণে টিকেট ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। ট্রেনের ভেতর কোন টিকেট চেকারের সাথেও সাক্ষাৎ হয়নি। কোনরূপ ঝামেলা ছাড়াই গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে গেলেন। স্টেশনে পৌঁছার পর তিনি বাইরে বের না হয়ে গেলেন টিকেট কাউন্টারে এবং ক্রয় করলেন গন্তব্যস্থল থেকে পূর্বের স্টেশনের দুইটি টিকেট। টিকেট ক্রয় করে টিকেট দুইটি হাতে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন। সঙ্গী অবাক হয়ে এর কারণ জানতে চাইলে সূফি সাহেব বলেন, ”সরকারি ট্রেনে ভ্রমণ করার কারণে সরকার আমার নিকট পাওনাদার; আমি যে স্টেশন থেকেই টিকেট কাটি না কেন তা পৌঁছে যাবে সরকারের নির্দিষ্ট খাতে”।
আরেকটি ঘটনা এমন ছিল, আলহাজ্ব সূফি আব্দুল কাদের (রহঃ) মাঝে মাঝেই দুপুরের খাবার লাকসাম দৌলতগঞ্জ এতিমখানায় বসে গ্রহণ করতেন। কিন্তু তাঁর খাবার আসতো তাঁর নিজ বাসা থেকে। তাঁর সহধর্মীনি এবং পুত্রবধূ এই খাবার প্রস্তুত করে পাঠাতেন। খাবারের সাথে সবসময় আলাদা করে লবণ পাঠানো হত। একদিন ভুলক্রমে লবণ পাঠানো হয়নি। এতিমখানা থেকে শুধু লবণ নিতে বলা হলে তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন, ”এই এতিমখানায় আমি পানি ব্যতীত আর কিছুই গ্রহণ করতে পারবনা; যেহেতু পানি পাতাল থেকে উঠে এবং আল্লাহর দান পানি-যা বিনামূল্যে পাওয়া যায়”।
(চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন