অফশোর বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইনগত সহায়তা প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার কাছে রক্ষিত তথ্যাবলী ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) ফাঁস করে দিয়েছে। পানামা পেপার্স নামে পরিচিত মোসাক ফনসেকার হাতে থাকা কোটি কোটি গোপন দলিল বিশ্বের প্রায় সকল প্রান্তের লাখ লাখ প্রভাবশালী মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের গোপন বিনিয়োগ ও অর্থপাচারের তথ্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাদের হস্তগত প্রায় ১১.৫ মিলিয়ন ডকুমেন্টে নামে-বেনামে অনেক বাংলাদেশীও এমন রয়েছে, যারা বিগত কয়েক দশক ধরে গোপনে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পন্থায় বিদেশে অর্থ বিনিয়োগ ও টাকা পাচারের সাথে জড়িত রয়েছে। এমনিতেই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের বিষয় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত ইস্যু হিসেবে গণমাধ্যমে উঠে আসছিল। বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থা থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচারের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। সর্বশেষ দফায় প্রকাশিত পানামা পেপার্সে দুই লক্ষাধিক ডকুমেন্টে বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। দ্বিতীয় দফায় ভারতের সহস্রাধিক (১০৪৬) এবং পাকিস্তানের ২৫৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অফশোর একাউন্টের তথ্য উঠে এসেছে। সে তুলনায় তালিকায় বাংলাদেশীদের সংখ্যা কম হওয়ার পেছনে বাংলাদেশীদের ঠিকানা গোপন করাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষকরা। এমনকি পানামা পেপার্সে বাংলাদেশের ঠিকানায় উল্লিখিত ব্যক্তিদেরও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে জানা যায়।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অফশোর একাউন্টের মাধ্যমে ‘সেকেন্ড হোম’ এবং ‘ইনভেস্টমেন্ট ট্যাক্স হ্যাভেন’ নামে পরিচিত স্থানগুলোতে ভুয়া কোম্পানীর নামে বিগত দশকে বাংলাদেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা পাচারের সাথে নামে-বেনামে মাত্র ৫০ জন ব্যক্তি ও ৫ প্রতিষ্ঠানই জড়িত নয়। আরো অসংখ্য রাঘব বোয়াল এ কাজে জড়িত, এটা নিশ্চিত। প্রকাশিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনো পাওয়া না গেলেও এরই মধ্যে কিছু ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে যারা সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত পরিচিত ও প্রভাবশালী। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়টি এমনিতেই আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। পানামা পেপার্স বা উইকিলিকস’র তথ্য ফাঁসের আগে থেকেই এ সংক্রান্ত বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ একটি গণদাবীতে পরিণত হয়েছিল। পানামা পেপার্স জনগণের সে দাবীকে আবারো সামনে নিয়ে আসলো। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন পানামা পেপার্স-এর আলোকে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে। প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১১ জনকে তলব করা হলে তাদের মধ্য থেকে ৬ জনের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়। ইতিমধ্যে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ক্ষমতাসীনদলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এ তালিকায় রয়েছেন বলে গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অবশিষ্ট সবাইকেই দুদকে তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের সাথে জড়িত প্রভাবশালী রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে।
আইসিআইজে’র মাধ্যমে পানামা পেপার্স ফাঁস হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে দুর্নীতি বিরোধী উদ্যোগ জোরদার হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। গত মাসের শুরুতে ফাঁস হওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্দুর ডি গনলোউগসন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রথম দফায় ফাঁস হওয়া পানামা পেপার্সে নাম থাকা ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, কানাডা থেকে শুরু করে ভারত-পাকিস্তান পর্যন্ত নিজ নিজ নাগরিকদের অফশোর অর্থ পাচার সম্পর্কে তথ্য উদ্ঘাটনে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় দফায় দুই লক্ষাধিক চাঞ্চল্যকর ডক্যুমেন্ট ফাঁস হওয়ার পর এই উদ্যোগ যে আরো জোরদার হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। গত এক দশকে বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা এখন ওপেন সিক্রেট। শেয়ারবাজার, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ডেস্টিনি, হলমার্ক- বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি পর্যন্ত বড় বড় অর্থ কেলেঙ্কারির সাথে কারা কিভাবে জড়িত তা’ খুঁজে বের করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা লক্ষণীয়। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় এসব অর্থ-কেলেঙ্কারির তদন্ত ও বিচারে অস্বাভাবিক ধীরগতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। পক্ষান্তরে, দেশ থেকে নানাভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথমতঃ সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি প্রভাবশালী মহল রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সর্বদা দেশের সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যস্ত রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিনিয়োগে সক্ষম অনেক ব্যক্তি বিদেশে টাকা পাচার করে দিচ্ছে। এভাবেই দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রাজনৈতিকÑঅর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের দ্বারা বিনষ্ট হচ্ছে। পানামা পেপার্সে হয়তো সব রাঘব বোয়ালের নাম আসবে না। আমাদের সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে, দেশের মানুষ তা’ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। অনতিবিলম্বে তাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। যত প্রভাবশালীই হোক, যথাশীঘ্র তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সাথে দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন