সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

খাবারে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ভাবতে হবে এখনই

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

মাছ-মুরগির খাবারে ক্রোমিয়াম, যা কিনা ক্যানসার সৃষ্টি করে। এমন সংবাদে আতঙ্ক সৃষ্টিতো হবেই। ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার বিভিন্ন কারখানায় তৈরি মাছ-মুরগির আর মাছের খাবারে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান ক্রোমিয়ামের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি প্রমাণ পাওয়া গেছে। স¤প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালু রাজধানীর ক’টি পোলট্রি ফিড প্রস্তুত কারখানায় অভিযান চালায়। সেখানে প্রাপ্ত নমুনা তাৎক্ষণিক পরীক্ষায় মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ট্যানারি শিল্পের কাঁচামাল তথা গবাদিপশুর চামড়া, হাড়সহ অন্যান্য বিক্রয়যোগ্য উপাদানে বিপজ্জনক মাত্রায় এই উপাদানটি ব্যবহার হয়। ট্যানারি বর্জ্যে তৈরি পোলট্রি ফিডেও থেকে যায় এই বিষাক্ত উপাদান। ফলে কেবল পোলট্রি ফিড নয়; অন্যান্য উৎপাদনেও এই বর্জ্যরে ব্যবহার এমনকি নির্বিচার নিক্ষেপেও জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। এই প্রাণঘাতী প্রবণণা রোধে দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আমরা চাই, খোদ ট্যানারি বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেই জোর দেয়া হোক। পোলট্রি ফিডে ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি এই বর্জ্য যাতে পরিশোধন করা হয়, সেজন্যও চাই কড়া নজরদারি ও নিয়মিত অভিযান। এ কথাও মনে রাখতে হবে, সকল পোলট্রি ফিড উৎপাদকই অসাধু। আবার সব মাছ-মুরগির খামারেই বিষাক্ত ক্রোমিয়ামযুক্ত খাবার ব্যবহার করা হচ্ছে তাও না। কোনোভাবে এ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা যাবে না। আতঙ্ক সৃষ্টি নয়, কেবল দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমনকি সংবাদমাধ্যমেরও উচিত এ বিষয়টি স্পষ্ট করা যে, কেবল বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য থেকে তৈরি পোলট্রি ফিডেই বিষাক্ত ক্রোমিয়ামের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মিলেছে। একই সঙ্গে এর জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তম‚লক শাস্তির বিকল্প নেই। বড় অপরাধে লঘু শাস্তি যেন না হয়। তাতে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে, আবারো একই অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ হবে। দেশে লাখ লাখ মানুষের ক্যানসার, কিডনি বিকল ও যকৃৎ নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী এক শ্রেণির অসাধু কারখানা-মালিক। এরা মাছ-মুরগির বিষাক্ত খাবারের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করবে আর ধরা পড়লে তাদের দিতে হয় মাত্র ১/২ লাখ টাকা। জরিমানার ওপর দিয়েই সব খালাস!
আগে হাঁস-মুরগি বড় হতো প্রাকৃতিকভাবে। রান্না করা ভাত, ধানের কুড়া ও ভুষি খেয়ে। আর ফার্মের মুরগির খাবার হলো দানাদার। যার সঙ্গে মিশ্রিত থাকে নানা রকম রাসায়নিক। এসব খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি বড় হয় ফার্মের মুরগি, ওজনও বাড়ে। এসব খাবারে লুকিয়ে আছে মরণঘাতী ব্যাকটেরিয়াসহ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক জীবাণু। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। বাজারে বিক্রি হওয়া হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য (পোলট্রি-ফিশ ফিড) খাওয়ানো মুরগি কেটে এর রক্ত, মাংস, হাড়, কলিজা, মগজ ও চামড়া আলাদাভাবে পরীক্ষা করে আঁতকে উঠেছেন গবেষকরা। প্রথম দফায় এক মাস এসব খাদ্য খাওয়ানোর পরে এবং দ্বিতীয় দফায় আরেক মাস খাদ্য খাওয়ানোর পরে পরীক্ষা করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। এসব মুরগির মাথার মগজে সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্রোমিয়াম পাওয়া যায়। ক্রোমিয়াম হলো এক ধরনের ভারী ধাতু, মানবদেহে যার সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হলো প্রতিদিন ২৫ পিপিএম বা মাইক্রোগ্রাম। এর বেশি হলে বেশিটুকু শরীরে জমা হতে থাকবে এবং একপর্যায়ে প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু পরীক্ষায় এক মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে পাওয়া যায় ৭৯৯ পিপিএম এবং দুই মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে (প্রতি কেজিতে) পাওয়া যায় চার হাজার ৫৬১ পিপিএম। এ ছাড়া মাংসে যথাক্রমে ২৪৪ ও ৩৪৪, চামড়ায় ৫৫৭ ও ৩২৮, হাড়ে এক হাজার ১১ ও এক হাজার ৯৯০, কলিজা বা লিভারে ৫৭০ ও ৬১১ এবং রক্তে ৭১৮ ও ৭৯২ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই মাত্রা মানবদেহের জন্য অসহনীয়।
প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হাঁস, মুরগি ও মাছ খেয়ে মানুষ মূলত গ্রহণ করছে ক্ষতিকর রাসায়নিক, যা মানুষকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। আমরা যে প্রতি দিন বিষ খাচ্ছি এ ভাবনাটা আমাদেও দেশের মানুষের মধ্যে নেই। শ্রীলংকায় ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে তৈরি বিষাক্ত হেভিমেটাল যুক্ত খাবার নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে শ্রীলংকায় হেভিমেটালযুক্ত খাবার ব্যবহার করা হতো। এক পর্যায়ে শ্রীলংকার একটি গ্রামে যখন বহু মানুষের কিডনি সমস্যা দেখা দেয়, তখন এটি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ওই গ্রামে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, হেভিমেটালযুক্ত খাদ্য খাওয়া হাঁস, মুরগি ও মাছের মাধ্যমে এটি হয়েছে। বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে তৈরি সার কৃষি জমিতে ব্যবহারের ফলেও কিডনি রোগ হয়। পরে শ্রীলংকা এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। কেউ করলে মৃত্যুদÐের বিধান রয়েছে। আমাদেরও এমনটা করা উচিৎ।
ঢাকায় স্থানীয় গবেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে, ট্যানারি বর্জ্য থেকে তৈরি পোলট্রি ফিডের প্রতি কেজিতে ৮ হাজার মিলিগ্রাম ক্রোমিয়ামের অস্তিত্ব রয়েছে। যেখানে মানবদেহে ক্রোমিয়ামের সহনীয় মাত্রা প্রতি কেজিতে .০৫ থেকে .২ মিলিগ্রাম পর্যন্ত, সেখানে এই পোলট্রি ফিড খাওয়ানোর পর মুরগি ও মাছের মধ্যে প্রতি কেজিতে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকশ’ গুণ বেশি ক্রোমিয়াম জমা হয়। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়ামযুক্ত মুরগি ও মাছ খাওয়ার পর মানবদেহের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গে ক্রোমিয়াম জমা হতে থাকে এবং এক সময় তা দুরারোগ্য ব্যাধির মাধ্যমে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। যে তাপমাত্রায় মাছ-মাস রান্না হয় তাতে ক্রোমিয়ামের কার্যকারিতা নষ্ট হয় না। ক্রোমিয়াম মানব দেহকোষের ডিএনএ’র গঠন ভেঙে দুরারোগ্য ক্যানসারসহ জেনেটিক রোগের সৃষ্টি করে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে দেড় লক্ষাধিক মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং লক্ষাধিক রোগী কার্যত বিনা চিকিৎসায়ই মারা যায়। দেশে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যবস্থা ও সুযোগ অণ্যন্ত সীমিত।
কল-কারাখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার এবং পোল্ট্রি ফিড ও খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল ও মাননিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্যানসার, কিডনি, লিভারসহ যাবতীয় জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে বাজারে থাকা সব পোলট্রি ফিডই বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য ব্যবহার করে না। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়ামযুক্ত, মানহীন স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে এমন পোলট্রি ফিড কারখানাগুলো বন্ধ করার পাশাপাশি পোলট্রি ফিড যেন আমদানি নির্ভর না হয়ে পড়ে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
ক্যানসার রোগের অন্যতম বীজাণু ক্রোমিয়াম মিশ্রিত খাবারেই আমাদের চারপাশে প্রতিপালিত হচ্ছে মানুষের খাদ্য তালিকার অন্যতম মাছ এবং মুরগি। বলাবাহুল্য যে, আমরা প্রতিদিন যেসব খাদ্য গ্রহণ করছি তার বেশির ভাগই বিষাক্ত কেমিক্যাল যুক্ত। এক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি খাদ্য আদালত গঠনের কাজটি যত দ্রæত সম্ভব করা উচিৎ। সরকার জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। সর্বশেষ যারা মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন