শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা ঠেকাতে হবে

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:১১ এএম

অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে তা হাল আমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায়। শুধু ধর্ষণই নয়, দেশে ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ। অপরাধীর সাজা না হলে এ জাতীয় অপরাধ বাড়বে, এটি অবধারিত। এ ধর্ষণ শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে, দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণকারীর সাজা না হওয়া তার অন্যতম কারণ। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশি। যাঁরা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, এই জাতীয় বিপদ তাঁদের ছুঁতে পারে কম। যাঁরা নিম্নবর্গের মানুষ, তাঁরা সম্ভবত এখনও ধর্ষণকে স্বাভাবিক জ্ঞান করে। ভয়ে চুপ থাকে। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলেন না। তারা জানেন আইন-আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। অন্যায় কওে অপরাধীরা এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ঈমানী শক্তি হারিয়েছি। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে গেছি। তাই সমাজ থেকে সুখ, শান্তি বা আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালোবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের ইতিবাচক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত যৌন কামনার প্রভাবে আমাদের মধ্যে ধর্ষণ, জেনা, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদির প্রবণতা বাড়ছে।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে একাধিকবার চলন্ত বাসের ভেতর নারীর ওপর গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের হার ভারতের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সারা বছর ধর্ষণের ঘটনা নারী নির্যাতনের শতকরা ১৮ ভাগ, যা ভারতে ৯.৫ ভাগ। এছাড়া শুধু ঢাকায় সারা বছরে ধর্ষণের ঘটনা মোট নারী নির্যাতনের শতকরা ২০.৪৬ ভাগ, যা নতুন দিল্লীতে ৯.১৭ ভাগ। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মতো সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের অধিকাংশই এখনও তাঁদের ওপর নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো ঘটনার কথা প্রকাশ করতে চান না। আর ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তারা পুলিশের কাছে থানায় কিংবা আদালতে মামলা করেন না। তাই সরকারের খাতায় প্রতিবছর যতগুলো ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হচ্ছে প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন সমাজবিদরা।
ধর্ষণ বৃদ্ধি হওয়ার জন্য সরকার ও তার প্রশাসনের ব্যর্থতাও দায়ী, কারণ অন্যায়কারী এমন ঘৃণ্য অন্যায় করার পরও প্রশাসন নীবর থাকে। সরকারের যেন কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কারণ যারা এর শিকার হন তাদের বেশিরভাগই সবাই দরিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাই আইনও এদের পাত্তা দেয় না। তবে এর শিকার যদি প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার মেয়ে বোন, অথবা মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের মেয়ে-বোন হতো তা হলে আপরাধীরা শাস্তি পেত। তারা উচ্চ বর্গীয় তাই তাদের সন্তান-বোন আর স্ত্রীরা ধর্ষিত হওয়া সুযোগ কম। তবে মেয়েদের প্রতি পদেই বিপদের মোকাবিলা করতে হয় আজকের সমাজে, শ্রেণিবিভাগ ব্যতিরেকেই। উচ্চবর্গীয়রা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করেন বলে ঘরের মধ্যে তাদের বিপদ কিছু কম হতে পারে তবে পার্টিতে অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিতের হাতে, আর ঘরে নিকট আত্মীয় বা পরিচিতজনদের লাঞ্ছনা জোটার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আসল সমস্যাটা হলো কুরুচিপূর্ণ পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, সেটা কোনো শ্রেণিভাগ মানে বলে মনে হয় না। এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতাও এই মানসিকতা বদলাতে পারে না। তা নাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী, ডাক্তারের হাতে রোগী কিংবা ডাক্তারনী ধর্ষিত হয় কী করে?
ব্যভিচার সর্বযুগে, সর্বধর্ম মতে নিন্দনীয় ও নিকৃষ্ট পাপাচার। ধর্ষণের চূড়ান্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হলে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণে নিশ্চিত হলে হত্যাকারীর শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এ যাবৎ যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তার যথাযথ বিচার সম্পন্ন হয়েছে, এরূপ নজির কমই আছে। হয় চূড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা নয়তো সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রভাবিত করে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে ঠিকই। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা নির্বিচারে পাল্টা হত্যার হুমকি কখনো কখনো হত্যার শিকার ও হয়রানির শিকার হয়। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। এ ছাড়া অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে ও দণ্ডনীয় হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডনীয় হবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। এদেশে ধর্ষণের পাকাপোক্ত আইন আছে ঠিকই কিন্তু আইনেকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আইনের যারা প্রয়োগ করবেন তারা ঐ আইনের পথে হাঁটেন না। কখনো অর্থের লোভ কখনোবা হুমকি-ধমকিতে শুরুতেই গলদ দেখা দেয়। মামলার চার্জশিট গঠনের সময় ফাঁক-ফোকর থেকে যায়। তাই শেষে রায়ে ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার লোকজন সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। ধর্ষণ যেহেতু মস্ত অপরাধ, তাই এ মামলাগুলোর ক্ষেত্রে চার্জশিট গঠনের সময় কোনো মেজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের কোনো পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারিতে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত রিপোর্টের সময় ভিক্টিমের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা যেতে পারে। তাতে করে গোপনে চার্জশিট দাখিলের ফলে যে জটিলতা তৈরি হয় তা কমে আসবে।
সর্বোপরি নারীর ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর বাস্তবায়ন নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজটিই বেশি জরুরি। সে লক্ষ্যে আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা চাই। মনে রাখতে হবে, ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরেই বহু কর্মজীবী নারীকে সন্ধ্যার পর কর্মস্থল থেকে একাকী ঘরে ফিরতে হয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসন তা সুনিশ্চিত করবে, এমনটাই মানুষের প্রত্যাশা। ধর্ষকদের ধরতে হবে প্রথমে, এরপর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষিতাদের সার্বিক সহায়তা দেয়াটাও সরকারে মানবিক কর্তব্য। এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যাতে নারীরা ঘরের বাইরে নিজেদের নিরাপদ ভাবে। কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
লেখক: কলামিস্ট, গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন