শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বজ্রপাতে ব্যাপক প্রাণহানি

প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত বৃহস্পতিবার বজ্রপাতে অন্তত ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরো অন্তত ১৬ জন। রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়ায় কাঠের ব্রিজের কাছে দু’যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া পাবনায় দুই স্কুলছাত্রসহ ছয়জন, কিশোরগঞ্জে এক কলেজছাত্রসহ চারজন, রাজশাহীতে দুই মহিলাসহ পাঁচজন, নরসিংদীতে তিন মহিলাসহ চারজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনজন, নাটোরে এক মহিলাসহ তিনজন, নারায়ণগঞ্জে একজন, দিনাজপুরে একজন, হবিগঞ্জে একজন, নেত্রকোনায় দুইজন, পিরোজপুরে একজন, গাজীপুরে দুইজন, নওগাঁওয়ে একজন, নাটোরে দুইজন এবং সিরাজগঞ্জে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে একই দিনে নানা স্থানে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা অতীতে দেখা যায়নি। চলতি মৌসুমে এর আগে অন্তত ৭০ জন বজ্রপাতে মারা গেছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বিরল না হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাত অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই উদ্বেগজনক রূপ লাভ করেছে। এতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে বজ্রপাতে মারা গেছে ১ হাজার ২৪৯ জন, অর্থাৎ বছরে গড়ে ২৪৯ জন। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে বেশী মানুষ মারা যায়। চলতি বছর ইতোমধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা যা দাঁড়িয়েছে তাতে অনুমান করা হচ্ছে, এ বছর এ সংখ্যা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। জানা গেছে, বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মারা যায় কৃষক (৫১ শতাংশ), এরপর মারা যায় ঘরে থাকা মানুষ (প্রায় ২২ শতাংশ), রাস্তাঘাটে ও পানিতে থাকা মানুষ (প্রায় ১৪ শতাংশ), স্কুলশিশু (প্রায় ১১ শতাংশ) এবং আঘাতের শিকার হয়ে (প্রায় ২২ শতাংশ)।
আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। এটাই বজ্রপাতের সংখ্যাধিক্য ও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ। গড় তাপমাত্রা বাড়ার অনুপাতে ১৫ থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি বজ্রপাত হওয়ার পাশাপাশি আগামীতে বাংলাদেশে এর পরিমাণ আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে আবহাওয়ার পরিবর্তনের ধারায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ওই গবেষণায় বাংলাদেশ বজ্রপাতের সর্বোচ্চ হুমকিতে রয়েছে এবং এদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরো বেড়ে যেতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০টি বজ্রপাত হয়। সার্ক গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবেও একই তথ্য দেয়া হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, এক বছরে মাত্র ১৫০ বা তার কিছু বেশি লোকের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আসলে এ সংখ্যা ৫০০ থেকে ৮০০ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের ২০১০ সালের প্রতিবেদন মতে, প্রতি বছর সারাবিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে।
তথ্যাদি ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট যে, বজ্রপাত বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, সঞ্চালনশীল গভীর মেঘমালায় সংঘর্ষের ফলে বজ্রপাত হয়। তবে কখন সঞ্চালনশীল মেঘমালায় সংঘর্ষ হবে তা কারো পক্ষেই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। এর প্রতিরোধেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। সতর্কতা-সাবধানতা ছাড়া বজ্রপাতের ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই। দেখা গেছে, খোলা মাঠে, উন্মুক্ত স্থানে ও জলাশয়ে যারা কাজ করে, বজ্রপাতের শিকার হয় তারাই বেশি। স্কুলশিক্ষার্থীরাও বজ্রপাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মারা যায়। ঘরে বজ্রপাতের আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করা কঠিন হলেও খোলা মাঠে বা উন্মুক্ত স্থান থেকে দ্রুত সরে এলে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। লোহার সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি বজ্রপাত আকর্ষণ করে বলে ঝড়-বৃষ্টির আগেই সেগুলো ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে।  শহরে বড় বড় ভবন কীভাবে বজ্রপাতের আঘাত থেকে রক্ষা করা যায়, সেটাও বিবেচনায় রাখা জরুরি। কারণ, বহুতল ভবনে বজ্রপাত হলে অধিক সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জনসচেতনা বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মিডিয়াগুলো জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কীভাবে বজ্রপাত থেকে আত্মরক্ষা করা যায়, সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন ও প্রশিক্ষিত করে তোলা হলে প্রাণহানির সংখ্যা কমবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন