অর্থনৈতিক রিপোর্টার : গত কয়েক মাস ধরেই প্রকৌশল, জ্বালানি, ওষুধ খাত শেয়ারবাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে। এর মধ্যে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মোট লেনদেনের প্রায় ৫০ শতাংশই রয়েছে এই তিনি খাতের দখলে। অপরদিকে চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) এ খাতগুলো শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এক সময় জায়গাটি ছিল ব্যাংক খাতের দখলেও। শেয়ারবাজারের প্রাণ হিসেবে পরিচিত এই ব্যাংক খাত এখন বেশ তলানিতে।
শেয়ারবাজরের তালিকাভুক্ত ৩২৯টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রকৌশল এবং ওষুধ ও রসায়ন খাতের শেয়ারে নজর বিনিয়োগকারীদের। ব্যাংক খাতে প্রতি বিনিয়োগকারীদের এখন আর তেমন আস্থা দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজারে তিন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে তাদের অবদানও বাড়ছে।
ডিএসই’র তথ্য মতে, ডিএসইতে মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও তালিকাভুক্ত ৩২৯টি কোম্পানি মোট ২০টি খাতে বিভক্ত। এর মধ্যে প্রকৌশল, জ্বালানি ও ওষুধ এ তিন খাতের কোম্পানির সংখ্যা ৭৮টি। যা লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ১৩ শতাংশের সমান। অর্থাৎ ১৩ শতাংশ কোম্পানির দখলেই রয়েছে মোট লেনদেনের প্রায় ৫৩ শতাংশ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে ডিএসইতে মোট ১৯৮ কোটি ৩১ হাজার ২১৫টি শেয়ারের ৭ হাজার ৫০৪ কোটি ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৪৩ টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে এই তিন খাতের শেয়ারের মোট লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ৯৬৫ কোটি ৪৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৩১ টাকার। যা শতাংশের হিসেবে ৫২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ফলে চলতি বছরের শুরু থেকেই ক্রমাগতভাবে এ তিন খাতের অবদান বেড়েই চলেছে।
ভালো লভ্যাংশের পাশাপাশি ভালো ব্যবসা হওয়ায় ৭৮টি কোম্পানির মধ্যে অর্ধশতাধিক কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকছেন বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অন্য খাতের কোম্পানির শেয়ারের চেয়ে এ খাতের কোম্পানির শেয়ারগুলোতে ব্যবসা ভালো হওয়ায় ক্ষুদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও নজর এই খাতের দিকে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের মন্দার মাসে অর্থাৎ এপ্রিল মাসে ডিএসই’র লেনদেনের ৫২ দশমিক ৮৪ শতাংশ লেনদেন হয়েছে এ খাতের কোম্পানি থেকে। আর সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে পাট, টেলিকম, সিরামিক, আইটি, পেপার অ্যান্ড প্রিন্টিং, ব্যাংক ও বীমা খাতের শেয়ার। এসব খাতের কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে মোট লেনদেনের ১৫ শতাংশ।
এর মধ্যে অধিকতর স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা থাকায় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বীমা কোম্পানির শেয়ারে পচন ধরেছে। বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতা না থাকায় এসব কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে চলে এসেছে। পুঁজিবাজারে মহাধসের আগে ও তার পরের কয়েক বছর এ খাতের শেয়ারের লেনদেনের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমছে।
ডিএসইর পাশাপাশি দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রকৌশল এবং ওষুধ ও রসায়ন খাতগুলোর লেনদেনের পরিমাণ একই অবস্থা বিরাজ করছে।
ডিএসই’র মাসভিত্তিক লেনদেনের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোট লেনদেনে প্রকৌশল, জ্বালানি ও ওষুধ খাতের অবদান ছিল ৪২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ফেব্রæয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৯৩ শতাংশে। মার্চে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ২২ শতাংশে। আর এপ্রিল মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ৮৪ শতাংশে।
ডিএসইর এপ্রিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাসটিতে লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এ খাতে এপ্রিল মাসে লেনদেন ১ হাজার ৬৭২ কোটি ৫৯ লাখ ৫১ হাজার ৫৫৩ টাকা। যা শতাংশের হিসেবে ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ খাতে মোট ১৯টি কোম্পানি রয়েছে। মার্চ মাসে লেনদেনের শীর্ষে থাকা ওষুধ ও রসায়ন খাত। এ খাতটি এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এপ্রিল মাসে এ খাতের ২৭টি কোম্পানি থেকে মোট লেনদেন হয়েছে ১৩৪ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ১৭৫ টাকা। যা মোট লেনদেনের ১৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। মার্চ মাসে মোট লেনদেনের ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ লেনদেন হয়েছিলো এ খাতের।
ওষুধ খাতের পরেই রয়েছে প্রকৌশল খাত। এপ্রিল মাস শেষে এ খাতে মোট লেনদেন হয়েছে ৯৪৮ কোটি ৮৬ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৩ টাকা। যা শতাংশের হিসেবে ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মার্চ শেষে মোট লেনদেনে এ খাতের অবদান ১৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ফেব্রæয়ারিতে প্রকৌশল খাত লেনদেনে শীর্ষে ছিল। মাসটিতে মোট লেনদেনে প্রকৌশল খাতের অবদান ছিল ১৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। এ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩২টি।
মহাধসের আগে পুঁজিবাজারের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত এবং লেনদেনের শীর্ষে থাকা ব্যাংক খাত চলে এসেছে ৫ম স্থানে। এ খাতে তালিকাভুক্ত ৩০টি কোম্পানির মোট লেনদেন হয়েছে ৫২৯ কোটি ৯৩ লাখ ২২ হাজার ৯০৪ টাকা। যা শতাংশের হিসেবে ৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। মার্চ মাসে মোট লেনদেনে এ খাতের অবদান ছিলো ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ।২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাত লেনদেনে প্রথম স্থান ধরে রাখে। সে সময় মোট লেনদেনে ব্যাংক খাতের অবদান ২০ থেকে ২৫ শতাংশের ওপরে ছিল। মূলত ২০১১ সালের পর থেকেই শেয়ারবাজারে ব্যাংক খাতের অবদান কমতে থাকে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা জানান, এ খাতগুলোতে বেশ কিছু ভালো সরকারি কোম্পানি তলিকাভুক্ত হওয়ায় ভালো মুনাফা পাওয়ার আশায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। তাই ধস পরবর্তী পুঁজিবাজারেও বছরের পর বছর ক্রমাগতভাবে পুঁজিবাজারে অবদান বাড়ছে। অপরদিকে বেশ কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক কোম্পানির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে। এর ফলে ক্রমাগতভাবে এ খাতের অবদানও কমছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন