শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য অনেকটা মহামারী আকার ধারণ করেছে। নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একশ্রেণীর শিক্ষক দেদারছে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষাকে তারা অনেকটা পণ্যে পরিণত করেছেন। ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে কোচিংয়ে তাদের আগ্রহ বেশি। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদানের চেয়ে কোচিংয়ের মাধ্যমে আয়-রোজগারের দিকেই তারা বেশি মনোযোগী। কোচিং না করলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় নম্বর কম দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী কোচিংয়ে আগ্রহী না হলেও বাধ্য হয়ে তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকের কাছে কোচিং করতে হয়। ক্লাসে শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে কোচিংয়ের মাধ্যমে একশ্রেণীর শিক্ষকের অতিরিক্ত আয়ের এই প্রবণতা নিয়ে ইতোমধ্যে বহু লেখালেখি হয়েছে। এতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। ওই শ্রেণীর শিক্ষকদের নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হয়নি। তারা কোচিং চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদের কোচিং প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে আবারো আহ্বান জানিয়েছেন। গত শুক্রবার বাংলা একাডেমিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার মানোন্নয়ন বিষয়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের অধ্যক্ষদের নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, অতিরিক্ত রোজগারের চিন্তা বন্ধ করে ক্লাসে মনোযোগী হোন। কোনোভাবেই কোচিং বাণিজ্য চলবে না। প্রয়োজনে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস নেন। আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার নির্মাতা আপনারা। সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ হয়েছে, ভবিষতে লাখ টাকা হবে। শিক্ষামন্ত্রীর এ বক্তব্য সময়োপযোগী এবং বাস্তবতার নিরিখে তিনি এ কথা বলেছেন।
শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে ধরা হয়। মানুষ গড়ার কারিগর এবং জাতির মেরুদ- মজবুত করার মহৎ লক্ষ্য সামনে রেখেই একজন শিক্ষক এ পেশায় যুক্ত হন। শিক্ষক নীতি, আদর্শ, উন্নত চরিত্র ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানবিক গুণাবলীর মূর্তপ্রতীক। এ পেশায় অর্থ উপার্জনের বিষয়টি গৌণ, শিক্ষাদানই মুখ্য। দুঃখের বিষয়, এ সময়ে এসে অধিকাংশ সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার চেয়ে বাণিজ্যকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। একদিকে টিউশন ফি, উন্নয়ন ফি’র নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হচ্ছে, অন্যদিকে কোচিং করাকে অনেকটা অলিখিতভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন একেকটি কোচিং সেন্টারে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের একটি অংশ ক্লাসে শিক্ষাদানের চেয়ে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে কোচিংকে বেছে নিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোচিং না করলে শিক্ষার্থীদের শেখার মূল্যায়ন করা হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের একাধিক বিষয়ের কোচিং করতে হয়। এতে অভিভাবকদের যেমন শিক্ষকদের অনৈতিক অর্থলোভ মিটাতে হচ্ছে, তেমনি তাদের নিদারুণ অর্থকষ্টেও পড়তে হচ্ছে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং যেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে আমরা দেখেছি, যেসব শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় একটু দুর্বল তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ববোধ থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে ক্লাসের বাইরে আলাদাভাবে পাঠদান করতেন। এতে ওইসব শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মান অতুলনীয় পর্যায়ে পৌঁছত। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তারা পরিগণিত হতেন। এখন যেন এই আদর্শ ও নৈতিকতাবোধ একশ্রেণীর শিক্ষক কোচিংয়ের নামে বিক্রি করে দিয়েছেন। অস্বীকারের জো নেই, শিক্ষকদের সম্মানজনক জীবনযাপনে পর্যাপ্ত অর্থকড়ির প্রয়োজন রয়েছে। তবে তা ক্লাসে পাঠদানের পরিবর্তে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে উপার্জন করা কতটা শিক্ষকতার মূল চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তা ভেবে দেখা দরকার। এ ধরনের প্রবণতা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। তাদের মনে রাখা প্রয়োজন, এ পেশায় তারা যুক্ত হয়েছেন সেবা দান করার জন্য, অর্থ উপার্জনের জন্য নয়। অর্থ উপার্জন করতে চাইলে অন্য পেশা তাদের বেছে নেয়া উচিত ছিল। স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনে অর্থের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তার মানে এই নয়, শিক্ষকতার আদর্শ বিচ্যুত হয়ে প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে হবে। আমরা দেখেছি, শিক্ষকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণসহ বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করছে এবং পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে। তারপরও যদি শিক্ষকদের একটি শ্রেণী নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শের বিষয়টি ভুলে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কোচিং বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন, তবে এর চেয়ে পরিতাপের আর কিছু হতে পারে না। শিক্ষকদের এই অর্থ লোভ কোনোভাবেই কাম্য নয়। শুধু অর্থলোভই নয়, আমরা দেখছি, একশ্রেণীর শিক্ষকের চারিত্র্যিক স্খলনও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির মতো অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনার সাথে তারা জড়িয়ে পড়ছে। এতে গোটা শিক্ষক সমাজের প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধাবোধ, তা ধূলোয় লুটিয়ে পড়ছে। এক শিক্ষকের অপকর্মের কারণে পুরো শিক্ষক সমাজের মান-সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। শিক্ষকের কাছ থেকে যদি শিক্ষার্থীদের এ ধরনের আচরণের শিকার হতে হয়, তবে জাতি উন্নত চরিত্রের নতুন প্রজন্ম কীভাবে পাবে! যে শিক্ষক কোচিং বাণিজ্য করছেন, তার ছাত্র বা ছাত্রী যদি ভবিষ্যতে এ পেশায় যুক্ত হয়, তবে তারাও শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদানের পরিবর্তে কোচিংকেই প্রাধান্য দেবে। অর্থ উপার্জনের এই যে প্রক্রিয়া, এর মাধ্যমে কি শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদের আদর্শবিচ্যুতির পথ প্রদর্শন করছেন না? এতে কি কর্তব্য বহির্ভূত ও অনৈতিক পন্থায় একটি অর্থলোভী প্রজন্ম গড়ে তোলা হচ্ছে না?
আমরা মনে করি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত, সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি বাতিলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিতে হবে। সরকার এমপিওভুক্ত করবে, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করবে এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে কোচিং বাণিজ্য বাড়বে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, এ কথা এখন আর বক্তব্য-বিবৃতি ও আহ্বানে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, সরেজমিনে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে এবং তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোচিংকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের স্বচ্ছন্দে জীবনযাপনে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদেরও উচিত, মহান শিক্ষকতা পেশাকে সমুন্নত রাখতে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত না করা। শিক্ষকের মর্যাদা-নীতি, আদর্শ ও উন্নত চরিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ধরে রাখতে হবে। শিক্ষকদের দায়িত্ব কেবল পাঠ্যসূচিভুক্ত বিষয় শিক্ষাদান নয়, তাদের আর একটি বড় কাজ হলো, শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষাদান। কোচিং বাণিজ্য বাদ দিয়ে তারা ক্লাস পাঠদানে সময় দেয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক মান উন্নয়নে যতœবান হবেন, এটাই কাম্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন