দেশের কোথাও কারো জীবন নিরাপদ নয়। পুলিশের হিসাবেই প্রতি মাসে গড়ে ২৮৬ জন খুন হচ্ছে। নিরস্ত্র-নিরীহ সাধারণ মানুষ তো বটেই; এমনকি নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সশস্ত্র ব্যক্তিরাও নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছে না। গত শুক্রবার টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আনসার ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের হামলায় একজন আনসার কমান্ডারের নিহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে জননিরাপত্তা পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটেছে। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ওই আনসার কমান্ডারকে হত্যা করে এবং ১১টি অস্ত্র ও ৬৭০ রাউন্ড গুলি লুট করে নিয়ে যায়। কারা এই হামলা, হত্যা ও অস্ত্রলুটের সঙ্গে জড়িত এখনো তা স্পষ্ট না হলেও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের মতে, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী এটি স্থানীয় মাদক চোরাচালান চক্রের কাজ হতে পারে। কোনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গী গোষ্ঠীর কাজ বলে প্রতীয়মাণ হয়নি। বলাবাহুল্য, টেকনাফকে মাদক চোরাচালানী চক্রের স্বর্গরাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন চক্র এখানে মাদক চোরাচালানে লিপ্ত রয়েছে। শুধু মাদক চোরাচালানই নয়, এসব চক্র ভূমি দখল, চুরি-ডাকাতির সঙ্গেও জড়িত। এরা কাউকেই পরোয়া করে না এবং যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আনসার ক্যাম্পে হামলা, হত্যা ও অস্ত্র লুটের ঘটনা যেদিন ঘটেছে সেই দিনই টেকনাফ সদর ইউনিয়নে কথিত ইয়াবা চোরাচালানি এবং সন্ত্রাসী হিসাবে এলাকায় চিহ্নিত ভুট্টোর বাহিনীর হামলায় ৬ জন সাংবাদিক আহত হয়েছে।
অন্য আরেক খবরে জানা গেছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী এলাকায় এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত ভিক্ষুর লাশ তার গ্রাম থেকে কিছু দূরে ছোট একটি বিহারে পাওয়া গেছে। ৭০ বছর বয়সী এই ভিক্ষুকে ওই প্রত্যন্ত গ্রামে কারা এভাবে হত্যা করলো, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এবং এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত পুলিশ কোনো হদিস বের করতে পারেনি। সাম্প্রতিককালে ইমাম, যাজক, পুরোহিতসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হত্যা বা তাদের ওপর হামলার যে সব ঘটনা ঘটছে, ভিক্ষু হত্যা তার সঙ্গে সম্পর্কিত, না বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে নিঃসন্দেহে এটা গভীর উদ্বেগের বিষয় যে, বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের ওপর এবং মসজিদসহ বিভিন্ন উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা থামছে না। এতে সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই এক প্রকার আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের লক্ষ্যে কোনো দেশী-বিদেশী মহল হয়তো এই হত্যাকা- ও হামলার ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয়, কোনো ঘটনার ক্ষেত্রেই অকুস্থল থেকে দুর্বৃত্তদের কারো পাকড়াও করা সম্ভব হয়নি। তারা তাদের ‘মিশন’ শেষ করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। পরেও কোনো ঘটনার তদন্তে বিশেষ কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। দুর্বৃত্তরা অধরাই রয়ে গেছে। অনেকেই মনে করেন, ঘাতক-দুষ্কৃতীদের ধরতে না পারার কারণেই একই ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটতে পারছে।
জননিরাপত্তার এই ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি দেশের জন্য মোটেই শুভকর নয়। বিভিন্ন ঘটনায় এটা স্পষ্টতই প্রতিভাত হয় যে, কারো জীবনেরই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। জীবন সবচেয়ে মূল্যবান অথচ তা এখন সবচেয়ে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে সঙ্গতভাবেই দুটি বিষয় সামনে এসে যায়। প্রথমত: আইন-শৃংখলা বাহিনী মানুষের জীবন সুরক্ষায় শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত: ঘাতক-দুর্বৃত্ত দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারা দেশকে তাদের জন্য এক অভয় ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। কেন এহেন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিকারের সুদৃঢ় ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া এ মুহূর্তে কোনো বিকল্প নেই। পর্যবেক্ষকদের অভিমত এই যে, আইন-শৃংখলা বাহিনী তার মূল দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না বা করছে না। চরম দলীয়করণের শিকার আইন-শৃংখলা বাহিনী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে এতই ব্যস্ত ও তৎপর যে, জননিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালনে নজর দিতে পারেছে না বা দিচ্ছে না। অন্যদিকে অপরাধীদের সঙ্গে আইন-শৃংখলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের যোগসাজসের অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, এর সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতাও দিন দিন বাড়ছে। এই বাস্তবতায় জননিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভবপর নয় এবং ঘাতক-দুর্বৃত্ত-দুষ্কৃতীদের বেপরোয়া হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। সরকারকে গোটা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি হত্যা ও হামলার ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আশা করবো, টেকনাফের আনসার ক্যাম্পে হামলা ও হত্যাকা-, সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলা এবং বান্দরবানের ভিক্ষু হত্যার বিষয়ে আইন-শৃংখলা বাহিনী যথোচিত সক্রিয়তা ও তৎপরতা প্রদর্শন করবে এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনী ব্যবস্থা নেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন