রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল ও ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জের পূর্বাচলের লেক থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের কয়েক বছর কেটে গেলেও চাঞ্চল্যকর এ সব মামলার সুরাহা হয়নি। কোথা থেকে আনা হয়েছিল, কারা এনেছিলেন, লেকে কেন রাখা হলো, কারা রেখেছিলেন, কোথায় পাঠানো হচ্ছিল, নাকি দেশের অভ্যন্তরে কোনো সন্ত্রাসী-জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্য আনা হয়েছিল অথবা অন্য কিছু-কোনো জবাব খুঁজে পাননি তদন্তকারী কর্মকর্তারা। বছরের পর বছর ধরে চলা তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় অস্ত্র-গোলাবারুদের গোপন মজুদের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্টদের।
২০১৬ সালের জুন মাসে উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের দিয়াবাড়ি খালে পানির নিচে থাকা ১৩টি ট্র্যাভেল ব্যাগ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর পরের বছর ২০১৭ সালের জুন মাসে রূপগঞ্জের পূর্বাচল ৫ নম্বর সেক্টরে লেকে তল্লাশি চালিয়ে ৭৪টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্র ও গোলাবারুদের গায়ে উৎপাদনকারী দেশ, প্রতিষ্ঠান ও সিরিয়াল নম্বর নেই। এ থেকে ধারণা করা হতে পারে এটি একক কাজে ব্যবহারের জন্য আনা হয়নি। বড় ধরনের অপারেশন বা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে অথবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর জন্য এখানে মজুদ করা হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরো বলেন, রূপগঞ্জ ও দিয়াবাড়ীর আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ধরনগত মিল রয়েছে। এ কারণে একই গ্রুপ এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ করতে পারে। এ বিষয়ে স্থানীয় সোর্সের বাইরে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েও তদন্ত করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তদন্তের সাথে সংশ্লিস্ট্র কর্মকর্তারা।
পুলিশের করা জিডির বিবরণে জানা যায়, উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের দিয়াবাড়ি খালে ২০১৬ সালের ১৮ জুন সাতটি ব্যাগের ভেতর থেকে ৯৭টি পিস্তল, ৪৬২টি ম্যাগাজিন, এক হাজার ৬০টি গুলি, ১০টি বেয়নেট, ১৮০টি ক্লিনিং রড এবং ১০৪টি স্প্রিংযুক্ত বাক্স উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার পিস্তলের মধ্যে ৯৫টি ছিল সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের, আর দুটি নাইন মিলিমিটার বোরের। গুলির মধ্যে ২২০টি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোর পিস্তলের এবং ৮৪০টি নাইন এমএম পিস্তলের। ম্যাগাজিনের মধ্যে ২৬৩টি এসএমজির হলেও কোনো সাব মেশিনগান সেখানে পাওয়া যায়নি। বাকি ম্যাগাজিনগুলো ছিল পিস্তলের। পরদিন ওই খাল থেকে আরও তিনটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ভেতরে পাওয়া যায় এসএমজির আরও ৩২টি ম্যাগাজিন এবং ৮টি ক্লিনিং রড। আর ২৫ জুন তিনটি ব্যাগ থেকে সাত প্যাকেট বিস্ফোরক জেল, পাঁচটি ওয়াকিটকি, দুটি বড় আকারের ট্রান্সমিটার, দুটি ফিডার কেবল, প্লাস্টিকের ২২টি কৌটায় বিভিন্ন ধরনের আইসি, ট্রানজিস্টার, ক্যাপাসিটার ও সার্কিট, ৪০টি পলিথিনের ব্যাগে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, রূপালি ও সবুজ রঙের ৩২৫টি স্প্রিংযুুক্ত বাক্স উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়েছিল, তুরাগ থানা থেকে দক্ষিণখান থানায় বদলি হওয়া কনস্টেবল শহিদুল ইসলাম ১৮ জুন স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে খালের পাশে বেড়াতে গেলে আকস্মিকভাবে ওই অস্ত্র-গোলাবারুদের সন্ধান পাওয়া যায়। খালের পাড়ে নম্বর প্লেটবিহীন একটি কালো গাড়ি এবং আশপাশে চার-পাঁচজন লোক দেখে শহিদুলের সন্দেহ হয়। খালে কেউ লাশ ফেলছে মনে করে তিনি দ্রুত ওই এলাকা থেকে দূরে সরে যান এবং ফোন করে তুরাগ থানায় খবর দেন। পরে তুরাগ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে খালের পানিতে ট্রাভেল ব্যাগ দেখতে পায়। তবে ওই গাড়ি বা অন্য কাউকে পুলিশ সেখানে পায়নি। খালের পানিতে আরও অস্ত্র আছে কি না তা দেখতে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি চালানো হলে পরদিন আরও তিনটি ব্যাগ পাওয়া যায়। ছয় দিন পর ওই জায়গা থেকে কিছুটা দূরে ইলেকট্রনিক ডিভাইস বোঝাই আরও তিনটি ব্যাগ পাওয়া যায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম আদালতে অনুমতি নিয়ে রাজারবাগ অস্ত্রগারে রাখা রয়েছে। পরিত্যক্ত অবস্থায় কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বা মাদক উদ্ধার হলে প্রথমে জিডিই হয়। পরে তদন্তে যদি জানা যায় আগ্নেয়াস্ত্র বা মাদক কোথায় যাচ্ছিল, তখন সেই জিডি মামলায় পরিণত হয়। তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট্র সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, উদ্ধার করা অস্ত্র-গোলাবারুদের ম্যাটারিয়াল এ্যানালাইসিস করা হয়েছে। এর ব্যালাস্টিক পরীক্ষার রিপোর্টও পাওয়া গেছে। এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ দেশে কোন কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ ব্যবহার করে-সে বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব অস্ত্রের ব্যবহারকারী গ্রুপ সম্পর্কে তথ্য জানা গেলে-এর উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। আমরা জড়িতদের পাশাপাশি উৎস সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করছি বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে ২০১৭ সালের জুন মাসে রূপগঞ্জের পূর্বাচল ৫ নম্বর সেক্টরে লেকে তল্লাশি চালিয়ে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এ আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরকের মধ্যে ছিল ৭৪টি অত্যাধুনিক চাইনিজ এসএমজি, বিপুল পরিমাণ হ্যান্ড গ্রেনেড, রকেট লাঞ্চার, রকেট লাঞ্চারের প্রজেক্ট, অস্ত্রের ম্যাগাজিন, পিস্তল, হাই ফ্রিকোয়েন্সির নন ট্র্যাকার ওয়াকিটকিসহ কয়েকবস্তা গুলি উদ্ধার করে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত এজাহারভূক্ত সব আসামিকে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশ অদ্যবধি অস্ত্রের মজুতদাতাদের সন্ধান বের করতে পারেনি।
সিআইডির সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দু’দিন আগে একটি চাইনিজ এসএমজিসহ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের বাগলা গ্রামের মাদক ব্যবসায়ী শরিফ খানকে গ্রেফতার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। তার দেয়া স্বীকারোক্তিতে ১ জুন রাতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আরো তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য মতে ২জুন পূর্বাচলের ৩নং সেক্টর সংলগ্ন সী-শেল আবাসিক কোম্পানির বালুর নিচ থেকে একই ধরনের আরো দুটি চাইনিজ এসএমজি ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদলের সহায়তায় ৫নং সেক্টরের লেকের পানি থেকে বিশাল অস্ত্রভান্ডরের সন্ধান পাওয়া যায়। বর্তমানে সিআইডি মামলাটি তদন্ত করছে। শরীফ খান, শাহিন হোসেন, রাসেল, শান্ত, মুরাদ মিয়া ও সাব্বিরসহ ৭ জনকে গ্রেফতার করে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র এ এসপি মো. ইকবাল হোসেন দৈনিক ইনবিলাককে বলেন, এ মামলায় গ্রেফতারকৃত ৮জনের কাছ থেকে অস্ত্রের উৎস, কারা জড়িত বা গন্তব্য কোথায় এসব গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সন্দেহভাজন দুজনকে খোঁজা হচ্ছে। সিআইডির ধারণা, ওই দু’জন লেকে মজুত অস্ত্রের পাহারার দায়িত্বে ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উদ্ধারকৃত অস্ত্রের উৎস ও গন্তব্য কোথায় ছিল তা জানতে চট্টগ্রামের কয়লার জাহাজসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েও তদন্ত করা হয়েছে। আমরা জড়িতদের শনাক্ত, অস্ত্র ও গোলাবরুদের উৎস ও কারা জড়িত তা জানার চেষ্টা করছি। অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে সময় লাগবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে অস্ত্র- গোলাবারুদ অন্য কোথাও যাচ্ছিল, না কি দেশেই রাষ্ট্র বা সরকারবিরোধী কোনো গোষ্ঠীর হাতে যেত-তাও তদন্ত করা হচ্ছে।
সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, অস্ত্র-গোলাবারুদ ব্যাগে ভরার পর তা শক্ত ও বায়ু নিরোধক পলিথিন দিয়ে প্যাকেজিং করা হয়েছে। এই ব্যাগগুলো পানিতে ফেলে দেয়ার পরও সেখানে পানি প্রবেশ করেনি। অস্ত্রের ব্যালাস্টিক ও ফরেনসিক পরীক্ষায় তা জীবন্ত পাওয়া গেছে। অস্ত্র সংরক্ষণের কৌশল অবলম্বন করা চক্রটি আন্তর্জাতিক মানের। ব্যাগগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীরা ব্যবহার করে থাকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন