ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে আত্মঘাতী গাড়ি বোমা হামলা নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যে গতকাল রোববার পাকিস্তান সফরে এসেছেন সউদী আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। কঠোর নিরাপত্তা ও আয়োজনের মধ্যে গতরাতে তিনি রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমানবন্দরে নামেন। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এসময় তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ও সেনা প্রধান কামার বাজওয়া বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। ২০১৭ সালে যুবরাজ নিযুক্ত হবার পর পাকিস্তানে এটিই মোহাম্মদের প্রথম সফর।
পাকিস্তানের সরকারি মিডিয়া জানায়, পাকিস্তানের আকাশ সীমায় পৌঁছার পর জেএফ-১৭ থান্ডার জেটস এবং এফ-১৬ ফাইটার জেট সউদী যুবরাজকে বহনকারী বিমানকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসে। প্রটোকল ভঙ্গ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ব্যক্তিগতভাবে তাকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে নিয়ে যান। সেখানে সউদী যুবরাজকে লালগালিচা সংবর্ধনা এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী টুইটারে প্রিন্স মোহাম্মদকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, যুবরাজ তার পরিবারের সাথে মিলিত হতে [তার] নিজের দেশে আসছেন।
এর আগে সউদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবাইর একটি পৃথক বিমানে রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেন। সউদী প্রতিপক্ষকে স্বাগত জানাতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরায়শী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
উপ-প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সউদী যুবরাজের এ সফরে দেশ দু’টির মধ্যে এমওইউসহ ২১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সউদী সহায়তাই সঙ্কটে থাকা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ধরে রেখেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে ‘বেইল আউট’ নিয়ে ইসলামাবাদের মধ্যস্থতা চলছে। এর মধ্যে রিয়াদের ৬০০ কোটি ডলার ঋণ ইসলামাবাদকে খানিকটা স্বস্তি দিয়েছে বলে খবর।
এই সফর উপলক্ষে পাকিস্তানে এবার যে তোড়জোড় তেমনটি শেষবার দেখা গিয়েছিল ২০০৬ সালে যখন তৎকালীন সউদী বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজ এসেছিলেন। যুবরাজের নিরাপত্তার দিকটি নিজেই দেখছেন বলে জানিয়েছেন ইমরান খান। নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারণে রাজধানী ইসলামাবাদের মানুষকে যাতে হয়রানির শিকার হতে না হয় সে জন্য আজ সোমবার সেখানে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
এসব ছাপিয়ে যুবরাজের সফরের জাঁকাল আয়োজন সবার দৃষ্টি কেড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঃ
পাকিস্তানের পিএম হাউসে থাকা প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি হবেন যুবরাজ বিন সালমান। রাজকীয় রক্ষীসহ ৪০ সদস্যের বিশাল এক দলের নেতৃত্ব দেবেন যুবরাজ তিনি। নূর খান এয়ারবেস থেকে হেলিকপ্টারে করে পিএম হাউসে উড়ে যাবেন যুবরাজ। পিএম হাউসের নিরাপত্তায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে থাকবে সউদী নিরাপত্তা দলও। দুটি সি-১৩০ এয়ারক্রাফট উড়ে এসেছে পাকিস্তানে। এগুলোতে করে নেয়া হয় বিএমডবিøউ সেভেন সিরিজের সাতটি বিলাসবহুল গাড়ি ও একটি ল্যান্ড ক্রুজার। যুবরাজ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন আসবাব, ব্যায়ামের সরঞ্জামসহ প্রচুর ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস। এগুলো পিএম হাউসে নিয়ে যেতে আটটি কনটেইনার লেগেছে। যুবরাজ ও তাঁর প্রতিনিধিদলের জন্য ইসলামাবাদের আটটি হোটেলের ৭৫০টি কক্ষ ভাড়া করা হয়েছে। এসব হোটেলে আগের বুকিং বাতিল করা হয়। নিরাপত্তার খাতিরে হোটেলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। যুবরাজের চারপাশে থাকছেন রাজকীয় প্রতিনিধি, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। এ সফরের খরচ বহন করছে সউদী সরকার। যুবরাজ যেসব যানবাহন ব্যবহার করছেন, সেগুলো একটি বিশেষ ফ্লাইটে করে আনা হয়েছে। এই সফরে সউদী চিকিৎসক, গণমাধ্যমের কর্মীও রয়েছেন। যুবরাজের সফরকে ঘিরে দুটি শহরে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। রাজধানী ইসলামাবাদে গতকাল ও আজ ১৪৪ ধারা জারি করা থাকছে। ইসলামাবাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নূর খান এয়ারবেসের চারপাশে চিরুনি তল্লাশি ও অভিযান চলছে। দুদিনের জন্য মোবাইল সার্ভিস আংশিক স্থগিত করা হয়েছে। পুলিশের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। দুটি শহরে এক হাজার এবং প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে পাঁচটি করে চৌকি বসানো হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। এলিট ফোর্স কমান্ডোদের গুরুত্বপূর্ণ ভবনের ছাদে ও সংবেদনশীল পয়েন্টে নিয়োগ করা হয়েছে। সড়কপথগুলোর পুরোপুরি নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন। দুই দিন প্রধান প্রধান সড়কে যানবাহন বেশি চলাচল করবে না। যুবরাজের বিমান অবতরণকালে পুরোনো বিমানবন্দর সড়ক বন্ধ ছিল। যানবাহনগুলোকে অন্য সড়ক দিয়ে পরিচালিত করতে ১০০ ট্রাফিক ওয়াড্রেন মোতায়েন করা হয়। দুটি শহরে গেস্ট হাউস ও ব্যক্তিমালিকানাধীন হোস্টেলগুলোতে তল্লাশি চালানো হয়। তল্লাশির সুবিধার্থে জনসাধারণকে জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্যান্য পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে বলা হয়েছে। যেকোনো ধরনের ড্রোন বা উড়ন্ত খেলনা দেখলেই গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সউদী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা থাকবেন রাজধানীতে। ভিভিআইপি চলাচলের জন্য ইসলামাবাদ এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোরাল চক থেকে ফয়সাল অ্যাভিনিউ ১৫ যেতে ইউ-টার্ন বেশ কয়েকবার বন্ধ রাখা হয়েছে।
সফরে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে বৈঠক করবেন যুবরাজ মোহাম্মদ। এরপর তিনি ইসলামাবাদে আফগান তালেবানদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতও করতে পারেন বলে পাকিস্তান সরকারের একটি সূত্র জানিয়েছে। বৈঠকে আফগানিস্তানে ১৭ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ অবসানে চলমান শান্তি আলোচনা নিয়ে মোহাম্মদের সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধিরা কথা বলবেন বলে মনে করা হচ্ছে। যুবরাজের এ সফরের মাধ্যমে ইসলামাবাদ ও রিয়াদের সম্পর্কের গভীরতা আরও দৃঢ় হবে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত ইসলামাবাদে অবস্থান করবেন। এরপর তিনি ভারতে যাবেন। বৃহস্পতি ও শুক্রবার যুবরাজ চীন সফরের মধ্য দিয়ে তার এশিয়া সফরের ইতি টানবেন। সূত্র : এএফপি, বিবিসি ও ডন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন