আরবি, ফার্সি, উর্দু, ইংরেজি এবং বাংলাসহ বিশে^র শতাধিক ভাষায় আল কোরআনের অনুবাদ ও তফসীর প্রকাশিত হয়েছে, যার সংখ্যা হবে কয়েক হাজার। এটি কোরআনের এক বিস্ময়কর মোজেজা, এক অভ‚তপূর্ব দিক। কোরআনি আয়াত, সূরা বিশেষ অর্থাৎ আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ও ব্যাখ্যা এবং তফসীর প্রভৃতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে জড়িত। এসবের মধ্যে অপ্রকাশিত-অমুদ্রিত অথবা পান্ডুলিপি আকারের কথা বাদ দিলেও যেগুলো মুদ্রিত হয়েছে, ছাপা হয়েছে এবং প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া কঠিন। একই কথা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তথাপি বিভিন্ন অপূর্ণ তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বাংলাভাষায় আল কোরআনের আংশিক/পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ব্যাখ্যা/তফসীর এ যাবত শতাধিক বলে অনুমান করা হয়।
বাংলা ভাষায় কোরআনের প্রথম অনুবাদ কখন কে করেন তাতে মতবিরোধ রয়েছে। তবে অনেকের মতে, বাংলায় কোরআনের প্রথম তর্জমা একখানা পুঁথির মাধ্যমে শুরু হয়। ‘তর্জমা আমছে পারা বাঙালা’ নামক পুঁথিটি ১৮৬৮ প্রকাশিত হয়। এর লেখক ছিলেন গোলাম আকবর আলী। তিনি কোন এলাকার অধিবাসী ছিলেন তা জানা যায়নি। এর পরবর্তী ‘আমপারার’ অনুবাদক হিসেবে রংপুরের আমীরুদ্দীন বশুনিয়ার নাম বলা হলেও সন-তারিখ অজ্ঞাত। কিন্তু কোরআনের বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ কখন থেকে আরম্ভ তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও একজন হিন্দু অনুবাদকের নাম সর্বাগ্রে দেখা যায়। তার নাম, ‘গ্রীশ চন্দ্র সেন’। তাঁর নামের সাথে অনেকে ‘ভাই’ ব্যবহার করে থাকেন। তাঁর জীবন কাল ১৮৩৫-১৯১০ বলে জানা যায়। তিনিই সর্ব প্রথম কোরআনের বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশ করেন বলে অনেকের মত। তাঁর অনূদিত কোরআন শরীফ তিন খÐে ১৮৮৬ সালে সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়।
বাংলাভাষায় কোরআনের চর্চার ইতিহাসে এই কোরআনের বঙ্গানুবাদ একটি বিশিষ্ট আসন অধিকার করে রেখেছে। ভারতবিভাগ পূর্বকালে বাংলা সাহিত্য চর্চায় যারা অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতেন তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল হিন্দুদের অনুপাতে অতি নগণ্য এবং তাদের মধ্যে যারা ইসলাম চর্চা করতে গিয়ে আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষা হতে বাংলায় অনুবাদ করতেন, তাদের আলোচ্য বিষয় ছিল কোরআন, হাদীস, ফেকাহ ইত্যাদি। তখন পর্যন্ত কোরআন ও হাদীসের বিক্ষিপ্ত বা আংশিক কিছু কিছু অনুবাদ থাকলেও বিশেষভাবে কোরআনের পূর্ণাঙ্গ কোনো বঙ্গানুবাদ ছিল না এবং প্রকাশ করার সুযোগ সুবিধারও অভাব ছিল।
১৮৮৭ সালে মওলানা আবদুল হক হক্কানী কৃত ‘তফসীরে হক্কানী’র উপক্রমনিকা ভাগ হতে প্রথম খÐ প্রকাশ করা হয় ‘ইসলাম তত্ত¡’ নামে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় খÐ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৮৮৮ ও ১৮৮৯ সালে একই ‘ইসলাম তত্ত¡’ নামে। এর আগে কোরআনের বঙ্গানুবাদের আর কোনো তথ্য জানা যায় না। সুতরাং, এ সময়টাকেই কোরআনের বঙ্গানুবাদের (আংশিক) সূচনাকাল বলা যায়।
কোরআনের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ কবে, কখন থেকে শুরু তা অনিশ্চিত, সরাসরি আরবি হতে বঙ্গানুবাদ কে, কখন করেন তারও কোনো হদিস পাওয়া যায় না। আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ ফার্সি অপেক্ষা উর্দু হতে সর্বাধিক বঙ্গানুবাদ হয়েছে, একথাও অকাট্য সত্য। এর প্রধান কারণ, এই উপমহাদেশে কোরআনের সর্বাধিক অনুবাদ হয়েছে উর্দু ভাষায় এবং সে সব উর্দু অনুবাদেরই বঙ্গানুবাদ সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়।
আগেই বলা হয়েছে যে, কোরআন শরীফের প্রথম বঙ্গানুবাদক কে ছিলেন তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও গ্রীশ চন্দ্র সেনের অনুবাদকেই সর্ব সম্মত বলে গণ্য করা যায়। তাঁর পূর্বে আংশিক অনুবাদক হিসেবে কয়েক জনের নাম পাওয়া গেলেও গ্রীশ চন্দ্র সেন ব্যতীত পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ অপর কোনো বঙ্গানুবাদকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেবের ‘শ্রদ্ধা নিবেদন’ খানা বঙ্গানুবাদের ২য় সংস্করণে স্থান পায় এবং তাতে প্রথম সংস্করণের কথা উল্লেখ করা হয়নি। তবে ৪ পৃষ্ঠা ব্যাপী এ ‘শ্রদ্ধা নিবেদন’ এ কোরআনের বঙ্গানুবাদের সাথে যেমন ‘সর্ব প্রথম’ কথাটি উল্লেখ করেছেন, তেমনি মোহাম্মদ (সা.) এর স্বরূপ গ্রন্থকেও ‘প্রথম’ বলে জানিয়েছেন। তার পরবর্তী সময়ে খোদ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর ‘তফছীরুল কোরআন’ বিগত ষাটের দশকের শেষদিকে ঢাকা হতে পাঁচ খÐে পূর্ণাঙ্গ প্রকাশিত হয়। গ্রীশ চন্দ্র সেনের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদও মওলানা আকরম খাঁর পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ-তফসীর ব্যতীত আরও নানা অনুবাদ-তফসীর প্রকাশিত হতে থাকে। উল্লেখ্য, বিগত সত্তরের দশকে সাবেক ‘ইসলামিক একাডেমী’ (পরবর্তী কালে ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন’) কর্তৃক নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের একটি বোর্ড অনূদিত ও সম্পাদিত কোরআনের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়, যার বহু সংস্করণ এ যাবত প্রত্যক্ষ করা যায়। উর্দু হতে অনূদিত বঙ্গানুবাদ কোরআন ও তফসীরের সংখ্যা বিপুল, যা এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে গ্রীশ চন্দ্র সেনের সাথে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেবের পরিচয় ও সাক্ষাতকার সম্পর্কে একটি চমৎকার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেবের শৈশবকালে তৎকালীন বিখ্যাত হিন্দু লেখক বাংলা সাহিত্যিক ভাই গ্রীশ চন্দ্র সেনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন মওলানা সাহেবের পিতা মওলানা আবদুল বারী খাঁ। তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সেই যুগে গ্রীশ চন্দ্রের ইসলাম সাধনা। একজন হিন্দু লেখক পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন এবং হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর জীবন চরিত রচনা করতে পারেন, তা ছিল তৎকালে অকল্পনীয় ও বিস্ময়কর। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেবর ভাষায়, ‘কোরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদক ও হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার প্রথম বাঙ্গালী চরিতকার ভক্তিভাজন ভাই গ্রীশ চন্দ্রের এ সমস্ত গুণই ছিল, তাই তার সাধনা সার্থক হয়েছে। ভাই গ্রীশ ভক্ত, সাধক ও অসাধারণ তেজোদৃপ্ত কর্মযোগী। তার গুণ-গরিমার পরিচয় দিতে যাওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই, তার কর্ম জীবনের সমালোচনা করার অবকাশও এই ক্ষেত্রে নেই। শুনেছি, কোরআনের ও অন্যান্য ইসলামী ধর্ম গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশের গুরুদায়িত্ব গ্রীশ চন্দ্রের উপর ন্যস্ত করার সময় ‘কেশব চন্দ্র’ প্রার্থনা করেছিলেন, ‘তোমার জীবন মহাপুরুষ মোহাম্মদের ‘স্পিরিট’ এ মহিমান্বিত ও অনুপ্রাণিত হোক।’ তার কর্ম জীবনের সব সাধনা ও সিদ্ধির মধ্যে এই প্রার্থনাটি সার্থক হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে আজ এইটুকু বললেই বোধ হয় যথেষ্ট হবে। বাংলার তিন কোটি মুসলমান জনসাধারণকে তাদের আল্লাহ’র, রসুলের ও কোরআনের সাথে পরিচিত করেছেন সর্বপ্রথমে তিনিই। তারই অক্লান্ত সাধনার সম্যক ফলেই বাংলার পাঁচ কোটি অধিবাসী কোরআন শরীফের, ইসলাম ধর্মের ও হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর স্বরূপ সর্বপ্রথম জানতে পেরেছিল। তাই গুরু হিসেবে, অগ্রপথিক হিসেবে এবং সত্যের অবিচল সেবক হিসেবে তার প্রতি অন্তরের গভীরতম শ্রদ্ধা নিবেদন করেই আজ ক্ষান্ত হচ্ছি।’
সেই ‘গুরু, অগ্রপথিক’-এর প্রতি মওলানার এইরূপ ভক্তি-দরদ তার প্রতি পিতা আবদুল বারী খাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা থাকাটাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই প্রতিভাধর গুণমুগ্ধের সাহচর্যে রাখার জন্য মওলানা আবদুল বারী খাঁ পুত্র মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ’কে মাঝে মধ্যে তার সান্নিধ্যে আনার চেষ্টা করেছেন এবং তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় গ্রীশ চন্দ্রে’র সাথে সাক্ষাৎ করে ধর্মালাপ করতেন। বালক আকরম খাঁ পিতার সাথে একাধিকবার গ্রীশ চন্দ্রে’র সমীপে উপস্থিত হয়েছিলেন বলে নিজেই কৃতজ্ঞতা সহকারে বর্ণনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমার বেশ স্মরণ আছে, শৈশবে পিতার সঙ্গে দুইবার গ্রীশ চন্দ্রের বাসভবনে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। উভয়ের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে ধর্মালাপ হয়েছিল। দ্বিতীয় দিন গ্রীশ চন্দ্র বাবাকে বলেছিলেন, আজও দেখছি খোকাকে সঙ্গে করে এনেছেন। বাবা বলেছিলেন, ছেলে মানুষ করা বড় দায়, ভাই সাহেব। তাই কিতাব পড়ানোর চেয়ে বেশী দরকার মনে করি সৎ সঙ্গের। গ্রীশ চন্দ্রের সেদিনকার সেই খোকা গুণমুগ্ধ ভক্ত হিসাবে, তিন কোটি বাঙ্গালী মুসলমানের পক্ষ হতে তাকে স্বশ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা নিবেদন করছি।’
সম্ভবত গ্রীশ চন্দ্রের ইসলাম ও কোরআন দর্শনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই পরবর্তীকালে সেই খোকা ‘মোস্তফা চরিত’ ও ‘তাফছীরুল কোরআন’ রচনায় আত্মনিয়োগ করে মুসলিম ইতিহাসকে অলংকৃত করেন। গ্রীশ চন্দ্রের পবিত্র কোরআনের বঙ্গানুবাদের ২য় সংস্করণে ‘শ্রদ্ধা নিবেদন’ শীর্ষক ভ‚মিকার উপসংহারে মওলানা সাহেব তার শৈশবকালের স্মৃতিচারণের কথাই উপরে আমরা তুলে ধরেছি। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত ৪ পৃষ্ঠাব্যাপী এই ‘শ্রদ্ধা নিবেদনে’ ভাই গ্রীশ চন্দ্র সেনের প্রতি মওলানা আকরম খাঁর শুধু অকৃত্রিম ভক্তি-শ্রদ্ধাই প্রকাশ পায়নি, বরং তার প্রতিভা ও ইসলাম দরদী মনোভাবেরও এখানে সঠিক চিত্র ফুটে উঠেছে।
ইসলাম ধর্ম ও হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর স্বরূপ সর্ব প্রথম বাংলার অধিবাসীরা জানতে পেরেছে গ্রীশ চন্দ্র সেনের রচনাবলীর মাধ্যমে। মওলানা আকরম খাঁ এই তথ্য পরিবেশন করে সত্যের সাধক হিসেবে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। গ্রীশ চন্দ্র সেন সত্যের যে পথ প্রদর্শন করে গেছেন সে পথে পরিচালিত হয়ে অর্থাৎ কলম পরিচালনা করে বাংলার মুসলিম লেখক, মণীষীগণ যে ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি করে চলছেন তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তারা মহানবী (সা.) এর পবিত্র সীরাতের নানা দিকের ওপর এবং ইসলামের বিভিন্ন দিকের ওপর হাজার হাজার বই-পুস্তক রচনা এবং বঙ্গানুবাদ করে বাংলা ভাষা সাহিত্যের পুষ্টি সাধনে এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন