নাটকীয় বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে। জিম্মি সঙ্কটের অবসানের দুঘন্টা পর গতরাতেই চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবার রহমান বলেছেন, ছিনতাইকারীর কাছে যে অস্ত্রটি পাওয়া গেছে এটা ফেইক, খেলনা পিস্তল। একই কথা বলেছেন, বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীও। গতরাতে এক টেলিভিশনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পিস্তলটি ছিল খেলনা। অন্যদিকে বিমান থেকে নেমে আসা যাত্রীরা গুলির কথা বললেও কমান্ডো অভিযান নিয়ে কথা বলার সময় চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান তা নাকচ করেছেন। তিনি বলেছেন, হয়তো ট্রমার কারনে যাত্রীদের এমন মনে হতে পারে।
বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে এছাড়াও বেশকিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হযরত শাহজালাল (রা.) বিমান বন্দর দিয়েই চট্টগ্রাম গেছেন। বিকাল সোয়া তিনটায় তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরেছেন। এজন্য আগের দিন থেকেই হযরত শাহজালাল (রা.) বিমানবন্দরে ছিল কঠোর নিরাপত্তা। প্রধানমন্ত্রীর বিমান ঢাকায় পৌঁছার আগে থেকেই সব ধরণের বিমান ওঠানামা বন্ধ ছিল। বিমান বন্দরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। সেই নিরাপত্তা ব্যুহ এড়িয়ে কি করে এই যুবক প্রবেশ করলো? স্বাভাবিকভাবেই যেখানে মাথা থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়। সেখানে খেলনা পিস্তল নিয়ে যুবকটি কিভাবে বিমানে উঠলো?
অন্যদিকে, ধৃত যুবক নিহত হওয়ায় যে প্রশ্নটি আড়ালেই থেকে গেল, সেটি হলো, যুবকের নাম পলাশ হলেও অভিযানের পর বলা হয়েছিল তার নাম মাহাদী? পরিচয় সনাক্ত হওয়ার পর র্যাব বলেছে পলাশ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আছে সে সম্পর্কে র্যাব কিচু বলেনি।
প্রশ্ন হলো কেন এই যুবক বিমান ছিনতাইয়ের নাটক মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিলেন? যুবকটি যে মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিল না তা তার বাড়ির এবং আশপাশের লোকজনের কথা বলে মিডিয়া নিশ্চিত করেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন বিমান ছিনতাইয়ের নাটক নাকি তার প্রেমিকাকে ফিরে পেতে? কিন্তু মিডিয়াতে কাজ করা যুবকের এরকম কোনো উদ্দেশ্যও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল। আর তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই বা কি কথা বলতে চেয়েছিলেন? প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, যুবকটি তার স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলতে চেয়েছিলেন। টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে বিশেষায়িত এই অভিযানে যুবককে আটকের কথা বলা হলেও এর কিছু সময় পরে নিহত হওয়ার কথা জানা যায়।
অভিযানের পরপরই এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান বলেছিলেন, ওই যুবকের কাছ থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, শুরুতে আমরা ছিনতাইকারীকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি। পরে সে আক্রমণাত্মক থাকায় স্বাভাবিক নিয়মে অভিযান চালানো হয়। এতে সে শুরুতে আহত হয়। পরে নিহত হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তিনি বলেন, বিমানের মধ্যে তার সাথে আমাদের অ্যাকশন হয়েছে, পরে সে বাইরে নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে বেবিচক চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান বলেছিলেন, সো ফার আমি জানি, তার কাছে একটা অস্ত্র ছিল। বলেছে গায়ে বোম্ব জড়ানো আছে বা তার জড়ানো আছে। ওটা কী ছিল, সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। ওই যুবকের আচরণ অসংলগ্ন ছিল বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত শুরুও হয়েছে। অপেক্ষা করতে হবে কি বেরিয়ে আসে তদন্তে। যে প্রশ্নগুলো জনমনে ঘুরপাক তার কতোটা উত্তর মিলে সেটিই দেখার বিষয়।
এদিকে, আমাদের সোনারগাঁও উপজেলা সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রামে বিমান ছিনতাই চেষ্টাকালে নিহত যুবকের আসল নাম মাহমুদ পলাশ (২৪)। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রামে। পলাশের নিহতের সংবাদে শত শত মানুষ তার বাড়িতে ভিড় করছে।
আজ সোমবার সকালে পলাশের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পলাশের ছবি নিয়ে তার বাবা পিয়ার জাহান ও মা রীনা বেগম শোকে কাতর।
পলাশের বাড়িতে ১১টি ঘর। তারই একটিতে বসে কথা হয় বাবা পিয়ার জাহানের সঙ্গে। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পলাশ তার একমাত্র ছেলে। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে জান্নাত নামে চার বছরের আরেকটি মেয়ে আছে।
পলাশের বাবা পিয়ার জাহান বলেন, ১৯৯০ সালে কাজের উদ্দেশ্যে তিনি ইরাক চলে যান। সেখানে চার বছর থাকার পর দেশে ফিরে আসেন। পরে তিনি আবার সউদী আরব চলে যান। ২০১২ সালে তিনি দেশে ফেরেন।
তিন বলেন, এর মধ্যে ছেলে পলাশ মাহমুদ তাহেরপুর ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা থেকে ২০১২ সালে দাখিল পরীক্ষা দিয়ে পাস করে। দাখিল পাস করে সে সোনারগাঁও ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে পড়া অবস্থায় সে ঢাকায় চলে যায়। তারপর থেকে তার আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়। শুনেছি পলাশ নাকি ঢাকায় চলচ্চিত্রে কাজ করার চেষ্টা করছিল। তখন বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না। মাঝে মাঝে বাড়িতে এলেও এলাকার মানুষের সঙ্গে মিশত না, কথা বলত না।
পিয়ার জাহান বলেন, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে চিত্রনায়িকা সিমলাকে নিয়ে রাতের বেলা বাড়িতে আসে পলাশ। মেয়েটিকে চিত্রনায়িকা ও তার প্রেমিকা বলে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। দুই মাস পর আবার সিমলাকে বাড়িতে নিয়ে এসে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিয়ের কথা সিমলাও আমাদের কাছে স্বীকার করে। ওই রাতেই তারা আবার ঢাকায় চলে যায়।
তিনি বলেন, আমরা সিমলাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তাকে বলেছি আমার ছেলেকে যেন ভালো পথে ফিরিয়ে আনে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটি অবাধ্য ছিল।
সর্বশেষ ২০-২৫ দিন আগে পলাশ বাড়িতে আসে। বাড়িতে আসার পর তার আচরণে বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করে, মসজিদে গিয়ে আজানও দিয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে বলেছে সে কাজের সন্ধানে দুবাই যাবে।
সোনারগাঁ থানার এসআই আবুল কালাম আজাদ জানান, বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনায় নিহতের ছবি রোববার রাত ১টার দিকে দুধঘাটা গ্রামের পিয়ার জাহানের বাড়িতে নিয়ে দেখালে তারা ছবিটি পলাশের বলে নিশ্চিত করে। তবে যতটুকু খবর নিয়েছি পলাশ নেশাগ্রস্ত ছিল। আর নেশার কারণেই বিমান ছিনতাইয়ের মতো জঘন্য অপরাধ করেছে সে।
উল্লেখ্য, ১৩৪ জন যাত্রী ও ১৪ জন ক্রু নিয়ে বিজি ১৪৭ ফ্লাইটটি গতকাল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাচ্ছিল। ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরই বিমানটি ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। পরে কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ছিনতাই নাটকের অবসান হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন