শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরও এমন এক শ্রেণীর লোক আছেন, যারা তমদ্দুন মজলিসের কাউকে দেখলেই তাদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলতে চেষ্টা করেন, এই এরাই পাকিস্তান সৃষ্টির পর সাত তাড়াতাড়ি ভাষা আন্দোলনের জন্ম দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভাঙার আয়োজন করেন। এদের রাজনৈতিক জ্ঞানের বহর দেখলে অবাক হতে হয়। দেড় হাজার মাইলের অধিক দূরত্বে অবস্থিত ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখণ্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। তাও যদি যে রাষ্ট্রটির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দুটি ভূখণ্ডের বিচ্ছিন্নতা বাস্তব আকার ধারণ করে, তার দৃষ্টিভঙ্গি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটির প্রতি বৈরী না হতো, তা হলেও কথা ছিল।
এই পরিস্থিতির বাস্তবতা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে। সে ইতিহাসে আমরা কী দেখতে পাই? ১৭৫৭ সালে পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়, একথা আমরা সবাই জানি। স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাবার আগে এদেশ মুসলিম শাসনাধীনে ছিল। মুসলিম শাসনামলে এদেশে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে গভীর সম্প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মুসলিম শাসকদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে সাম্রজ্যবাদী বৃটেন বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার দরবারের হিন্দু আমলা জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখের সাথে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করে তাদেরকে মুসলিম শাসক সিরাজউদ্দৌলাহকে উৎখাত করতে প্ররোচনা দিয়ে শেষ মুহূর্তে সিরাজউদ্দৌলাকে সরিয়ে মীর জাফরকে নবাব করার লোভ দেখিয়ে তাকে হাত করে। মীর জাফর এতে তার জীবনের এক বিরাট স্বপ্ন পূরনের সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে তাদের কথা অনুযায়ী যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণে রাজী হয়ে যায়।
এই গোপন ষড়যন্ত্রের ফলে পলাশী যুদ্ধের ময়দানে ইংরেজ বাহিনী কর্তৃক নবাব বাহিনী আক্রান্ত হলে নবাবের সেনাপতি মীর জাফর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। এর স্বাভাবিক পরিণতিতে পলাশীতে নবাব বাহিনীর পরাজয় ঘটে। সিরাজউদ্দৌলাহ পলাশীতে পরাজয়ের পর যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ইচ্ছা থাকলো গোপনে প্রস্তুতি নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবেন। সিরাজের সে স্বপ্ন আর বাস্তবে সফল হয়নি।
এদিকে মীরজাফরের নবাব হবার স্বপ্নও বাস্তবে সফল হয়নি। যদিও মীর জাফর কয়েকদিনের জন্য নবাবের সিংহাসনে বসেছিলেন, কিন্তু সিংহাসনে বসেই তিনি টের পেয়ে যান, তাঁর হাতে কোন ক্ষমতা নেই। সকল ক্ষমতা চলে গেছে ইংরেজদের এবং জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ প্রমুখ ইংরেজ সমর্থক হিন্দুদের হাতে। এরপর মীর জাফরের জামাতা মীর কাসেম শ্বশুরের ব্যর্থতার পর বাংলাা স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেও সে চেষ্টা আর সফল হয়নি। প্রথমে বাংলা বিহার উড়িষ্যা এবং পরে উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপমহাদেশের জনসাধারণ বিদেশী ইংরেজদের শাসন এক দিনের জন্যও খুশী মনে মেনে নিতে পারেনি। তারা পলাশীর পর এক শ’বছর ধরে বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে। এসব সংগ্রামের মধ্যে মজনু শাহের নেতৃত্বে ফকির আন্দোলন, হাজী শরীয়তুল্লাহ-দুদুমিয়ার নেতৃত্বে ফারায়েজী আন্দোলন, মহীশূরের টিপু সুলতানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ, শহীদ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর নেতৃত্বে জেহাদ আন্দোলন প্রভৃতি একের পর স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম চালালেও প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের অসহযোগিতা ও ইংরেজ পক্ষ অবলম্বনের কারণে তারা সকল সংগ্রামেই পরাজিত হন।
সর্বশেষে সংঘটিত ১৮৫৭ সালের সিপাহী অভ্যুত্থানেও মুসলমানরা পরাজিত হওয়াতে তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবৃন্দ আজাদীকামী মুসলমানদের সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে সাময়িকভাবে হলেও ইংরেজদের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ কাজে এগিয়ে আসেন উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং বাংলার নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ তদানীন্তন মুসলিম নেতৃত্ব। তারা ইংরেজ শাসকদের সাথে সাময়িকভাবে হলেও সুসম্পর্ক স্থাপন করে আধুনিক শিক্ষায় মুসলমানদের শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করেন। এ লক্ষ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান আলীগড়ে একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন, যা পরবর্তীকালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নীত হয়। অন্যদিকে নবাব আবদুল লতিফের চেষ্টার ফলে কলকাতার সরকারী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজের দরজা মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে সরকারী হিন্দু কলেজকে প্রেসিডেন্সী কলেজে রূপান্তরিত করা হয়।
পরবর্তী পর্যায়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ত্যাগ করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেন। ঢাকায় ১৯০৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহ উদ্যোগে একটি মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই শিক্ষা সম্মেলনে অন্যতম মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব এ আমন্ত্রন প্রত্যাখান করেন এই যুক্তিতে যে এটা করা হলে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কাজে সমস্যা সৃষ্টি হবে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে সে সময় রাজী না হলেও পরবর্তী কালে কঠোর বাস্তবতা বিবেচনায় এক পর্যায়ে নবাব সলিমুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত স্বতন্ত্র মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করে এই সংগঠনকে শক্তিশালী করার কাজে সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করে ‘কায়েদে’ আজম নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের কাছে।
ইতোমধ্যে ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সমূহ নিয়ে এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়, যার প্রতিটি ইউনিটই হবে স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম। সম্মেলনে একথাও জোর দিয়ে ঘোষণা করা হয় যে, এছাড়া অন্যকোন ব্যবস্থাই মুসলমানদের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না। কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন বাঙালী মুসলমানদের জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক।
এ প্রস্তাবে উল্লেখিত রাষ্ট্রের নাম কি হবে সে সম্বন্ধে কিছু না বলা হলেও পরদিন সকল হিন্দু সংবাদপত্রে এ সংবাদটি প্রকাশিত হয় “পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত” বলে। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগও এ দাবীকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী বলে মেনে নিয়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ আন্দোলনকে পাকিস্তান আন্দোলন বলে মেনে নেয় এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতবর্ষের সকল মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এই আহ্বানের আলোকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তুমুল আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
অবশেষে আসে ভারতবর্ষে ইংরেজশাসন অবসানে চূড়ান্ত পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পালা। ১৯৪৬ সালে এ লক্ষ্যে অবিভক্ত ভারতের সকল প্রদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ নির্বাচনে বর্তমান পাকিস্তানের কোন প্রদেশে নয়, একমাত্র বাংলাদেশেই মুসলিম লীগ নির্বাচনে জয় লাভ করে হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন করতে সক্ষম হয়। ফলে পাকিস্তান আন্দোলনে একমাত্র বঙ্গদেশেই সেই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতে মুসলিম লীগ সরকার পাকিস্তান আন্দোলনে কায়েদে আজমের হাতকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।
পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলাদেশের এই অসামান্য অবদান থাকার কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল বিরাট। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে এব্যাপারে চরম হতাশ হতে হয়। পাকিস্তান আমলে প্রথমে করাচী এবং পরে ইসলামাবাদ পাকিস্তানের রাজধানী নির্ধারিত হয়। এর ফলে সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমানের পাকিস্তান) অঞ্চল উন্নয়নের বিরাট সুযোগ লাভ করে। তাছাড়া সামরিক বাহিনীর সকল বিভাগ আর্মি, নেভী ও এয়ার ফোর্সের সদর দপ্তরও সেই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরাট প্রভাব থাকে। অন্যপক্ষে পূর্ববঙ্গ (বর্তমানের বাংলাদেশ) থাকে এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
এসব ছাড়াও আরেকটি বিষয় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমস্ত পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বঙ্গে বাস করতো সমগ্র পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অবাঙ্গালী তথা উর্দুভাষীদের বিরাট সংখ্যাধিক্যের সুযোগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ধরে নিয়ে পোস্ট কার্ড, মানি অর্ডার ফর্ম, এনভেলপ প্রভৃতিতে ইংরেজ আমলের ধারাবাহিকতায় ইংরেজীর সাথে শুধু উর্দু ভাষা ব্যবহার করা শুরু হয়। এতে পূর্ববঙ্গের সাধারণ শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ভাষা সম্পর্কে সরকারের বাংলা বিরোধী মনোভাব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যায়।
এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ১৫ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, না উর্দু শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। সুতরাং এ অভিযোগ আনা অত্যন্ত অন্যায় হবে যে, ভাষা আন্দোলন শুরু করা হয় পাকিস্তান ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। কারণ যারা ভাষা আন্দোলন শুরু করেন তারা সবাই ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। ভাষা আন্দোলনের মেনিফেষ্টো-রূপী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামের যে পুস্তিকা তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়, তাতে তিনটি রচনা স্থান লাভ করে। একটি তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল কাসেমের। অপর দুটি রচনা ছিল বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. কাজী মোতাহার হোসেন এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক আবুল মনসুর আহামদ কর্তৃক রচিত। শেষোক্ত দুজন ছিলেন যথাক্রমে ঢাকার পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ এবং কলকাতার পূর্ব পাকিস্তান রেনেসা সোসাইটির নেতা হিসাবে পাকিস্তান আন্দোলনের সাংস্কৃতিক নেতা।
“পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন যুক্তি ও তথ্য সরকার বুঝিয়ে বলা হয় যে যদিও পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা তবুও রাষ্ট্রীয় সংহতির স্বার্থে বাংলার সাথে উর্দুকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী মেনে নেন ভাষা সৈনিকরা। আগেই বলা হয়েছে, ভাষা আন্দোলন ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। এরপর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়। জন্মের পর হতেই এই সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সূচিত ভাষা আন্দোলনকে সক্রিয় সমর্থন দিতে থাকে। ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের কাজকে জোরদার করার লক্ষ্যে অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে কনভেনর করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ছাত্র লীগ ভাষা আন্দোলনে যোগ দেয়ার পর তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্র লীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে কনভেনর করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুর্নগঠিত হয়। এই সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে প্রথম সফল হরতাল সংগঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। সে হরতাল পূর্ণ সাফল্যমণ্ডিত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন চীফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ভাষা সৈনিকদের সকল দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর বাধ্য হয়েছিলেন।
১৯৭০ সালের আগে সমগ্র পাকিস্তানে এক সাথে কোন সাধারণ নির্বাচন হয়নি। এর আগে যে নির্বাচনে যুক্তফ্রণ্টের কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সংগঠন জনবিচ্ছিন্ন মুসলিম লীগ পরাজয় বরন করে সে নির্বাচন সীমাবদ্ধ ছিল পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে। ১৯৭০ সালে সমগ্র পাকিস্তানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন নির্দিষ্ট হওয়ার প্রেক্ষাপটে জয়ী আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগুরুত্ব লাভ করলেও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার নির্বাচনে ফলাফলের আলোকে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার পরিবর্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম ঘোষণা করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে। এর বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালী জনগণ জান কবুল করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মাত্র নয় মাসের মধ্যে তারা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
এই মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দানে এগিয়ে আসে বিশেষ শর্তাধীনে। সে শর্ত ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশে অবস্থান করবে ভারতীয় বাহিনী। কত দিনের জন্য তা জানাতে রাজী হয়নি ভারতের তদানীন্তন কর্তৃপক্ষ।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে লন্ডনে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় সেনা অবস্থানের বিষয়ে জানতে পারেন। তিনি কালবিলম্ব না করে এ বিষয়ে তাঁর ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেন। লন্ডন থেকে নয়াদিল্লী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকালে নয়া দিল্লীতে স্বল্প বিরতির প্রথম সুযোগেই তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম, আপনি কবে বাংলাদেশ থেকে আপনার সেনাবাহিনী ফেরৎ আনবেন? উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। বঙ্গবন্ধুর তখন বিশ্বব্যাপী যে জনপ্রিয়তা তার ফলে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে অন্য কোন জবাব দেওয়া সম্ভব ছিলনা ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর অপসারণ ত্বরান্বিত হয়। এভাবেই বাস্তবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন