এক.
অজর-অমর-অক্ষয়দের খাতায় নাম লিখিয়ে, মগবাজারের পাঠ চুকিয়ে, বাংলা একাডেমি, জাতীয় প্রেসক্লাব এবং বায়তুল মোকাররমের জানাজা শেষ করে আল মাহমুদ যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে যাত্রা শুরু করলেন, বিষাদে ভরে গেল আমার মন। একজন কবি চলে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন আল মাহমুদ প্রিয়তম শহর ছেড়ে। আর কি দেখা হবে! লোক-লোকান্তর পেরিয়ে হাতে নিয়ে কালের কলস, যিনি কবিতার সঙ্গে সম্পাদন করলেন অবিনাশী সোনালী কাবিন, আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ পাতাকা, সেই আল মাহমুদ চলে যাচ্ছেন। অথচ কী সাধারণ তার চলে যাওয়া। যে তিতাসের তীর থেকে উঠে এসে আমাদের শিখিয়ে গেলেন প্রকৃতির সমস্ত আয়াত, সেই সামান্য তিতাস তীরেই সাধারণভাবে চলে যাচ্ছেন অসামান্য আল মাহমুদ।
না, শাসকদের নেকনজর তিনি কাড়তে পারেননি। কারণ, তিনি কখনো বিশ্বাসভঙ্গকারীদের মতো পরেননি পোশাক। কারণ, তিনি খ্যাতি ও প্রতিপত্তির লোভে শয়তানের কাছে বিক্রয় করেননি আত্মা। তো, একজন ভাষাসৈনিক হওয়া সত্তে¡ও তার লাশ নেয়া গেল না কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। অথচ আল মাহমুদের পায়ের তলার ধূলির যোগ্য নন যারা, মৃত্যুর ৭ দিন পরে যাদের লাশ নেয়ার লোক পাওয়া যাবে না পৃথিবীতে, সেই সব নাদানকে নিয়েও সেখানে চালানো হয় শোকের তিন অংক নাটক। কারণ, তারা শাসকদের পায়ের তলায় আজীবন সেজদায় পড়েছিলেন। জাতীয় ঈদগাহে জানাজা করা গেল না। কারণ, তিনি জাতির গৌরব বাড়িয়ে গেছেন। অঙ্গুলিমেয় যে ক’জন কবি-লেখক সর্বস্ব পণ করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য নাম। বুদ্ধিজীবী কিংবা মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে তাকে দাফন করা গেল না, দেয়া গেল না রাষ্ট্রীয় সম্মান, বাজল না বিউগল। কারণ, মুক্তিযোদ্ধা হলেই তো হবে না, হতে হবে বিশেষ দলের দাস, আধিপত্যবাদের চাকর-বাকর। না, আল মাহমুদ ওইসব মহান(!) গুণের অধিকারী ছিলেন না। তো অবিমৃষ্যকারী সঙ্ঘবদ্ধ দাসানুদাসদের দম্ভ ও ঘেউ ঘেউ ঘোলা করে ফেলল মধ্য ফেব্রুয়ারির দুপুরকে।
কিন্তু ভ্রুক্ষেপহীন আল মাহমুদ। যার স্ব-স্বভাবে জেগে ওঠে বিশাল প্রকৃতি। যার অঙ্গুলি হেলনে নিসর্গও ফেটে যায় নদীর ধারায়। উচ্চারণে কেঁপে ওঠে মাঠ। ছত্রভঙ্গ মিছিল ও মানুষ অদ্ভুত রহস্য নিয়ে পাক খেয়ে এক হয়ে যায়। কবির যাত্রাপথের ভালোবাসার প্লাবনের সামনে ক্ষমতান্ধরা পরাজিত জীবের মতো বাধ্য হয়ে নিচু করে মাথা। আর নিজপুত্রের ঘরে ফেরার ব্যাকুলতায় আবেগে অস্থির হয়ে পড়ে তিতাস। যেন বাংলাদেশের তেরশ’ নদী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায় তিতাসের তীরে। যেন করুণ বিউগল ঠোঁটে নিয়ে ঝাঁকবেঁধে উড়ে এলো ভোরের দোয়েল। সাদা পালক বকেরা শামিয়ানার মতো বিস্তার করল ডানা। কাঁঠালচাঁপার বন যেন কবির যাত্রাকে মহিমান্বিত করার জন্য পথে পথে ছিটতে থাকল অপার্থিব আতর। শাসকরা যা কোনো দিন চোখেও দেখেনি। দেখবে না কোনোকালে।
আল মাহমুদের মতো কবির জন্যই তো আজ থেকে চারশ’ বছর আগে কবিগুরু মহাকবি আলাওল লিখে রেখে গেছেন:
‘কদাচ কবিরা নহে সামান্য মনুষ্য
নিশ্চয় জানিও কবি আল্লাহর শিষ্য’
অথচ সেই আল মাহমুদকে আমরা কীভাবে বিদায় জানালাম। ভাবা যায়? কী এমন হতো, যদি আমরা আমাদের যাপিত জীবনের সব রকম ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতা, বিভেদ, বিদ্বেষ, ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার তাড়া তাড়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড লাথি মেরে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিতাম। যদি আমাদের পচা নর্দমার দুর্গন্ধভরা হৃদয়গুলোকে জমজমের পানিতে ধুয়ে নিতে পারতাম, যদি ধূলি ও ধূসরতায় খানিকটা ওপরে উঠে এই পবিত্রতার গায়ে-গতরে রংধনুর রং মাখতে পারতাম প্রয়োজন মতো। তাহলে কী অসাধারণ দৃশ্যেরই না জন্ম হতো!
আল মাহমুদকে কেন্দ্র করে সরকারি উপেক্ষা আর সংঘবাদীদের কান্ডকারখানা দেখে আমার মনে হচ্ছে, এই জনপদ এখন আর কোনো মানবিক ভূখন্ড নয়। এটা যেন পরিণত হয়েছে জর্জ অরওয়েলের এনিমেল ফার্মে! আর আমরা সবাই তার বাসিন্দা!
দুই.
এখন থেকে একশ’ বছর পরে অথবা এক হাজার বছর পরে কিংবা আরো পরে, যদি তখনো মানুষ থাকে পৃথিবীতে। কেউ না কেউ প্রশ্ন করবে আমাদের সময় ও সমাজ নিয়ে, ন্যায়নীতি, সততা, দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব, বিচার ও প্রেমহীন একটি সময়ে ওই লোকগুলো বেঁচেছিল কীভাবে? সেই অনাগতকালের প্রশ্নকারীদের উদ্দেশ্যে এই হানাহানি, বিভেদ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, অসম্প্রীতি, অবিচার ও অবিবেচনায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া সময়ের পত্রহীন পুষ্পহীন, বাষ্পহীন, অনুতাপহীন প্রান্তর থেকে বলে রাখছি, যদি এই লেখা তাদের কাছে পৌঁছে, আমাদের অনেক কিছু ছিল না, এ কথা সত্য। বন্য পশুর কাদা ঘাঁটার মতো সীমিত, সঙ্কীর্ণ ও নোংরা হয়ে পড়েছিল আমাদের জীবন। তারপরও আমরা বেঁচেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম, আনন্দ ও বেদনার নুনপানিতে ভেসেছিলাম। শুধু একটি কারণে আমাদের মধ্যে আল মাহমুদ ছিলেন। কবি আল মাহমুদ ছিলেন। মাত্র একজন কবি ছিলেন বলে আমাদের প্রতিদিনকার রুমালগুলো সুচিকর্মময় ছিল।
আজকের এই দিনে এখনো যাদের মানুষ হিসেবে ধরে নেয়া যায়, এখনো যারা সাদা আর কালোর পার্থক্য কিছুটা হলেও ধরতে পারেন, সাহস করে তা বলতে পারেন, তাদের বলি, আল মাহমুদ আমাদের মধ্যে আছেন বলেই আমরা ছিলাম। যে কয়টি সংবাদ আমাদের প্রতিটি সূর্যোদয়কে সম্ভাবনাময় করে তুলত, তার অন্যতম ছিল আল মাহমুদের বিচরণশীলতা, তার সচলতা ও সক্ষমতা। তার বহমান সৃষ্টিশীলতা। তিনি ছিলেন বলেই আমাদের দিনগুলো কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতেও হারিয়ে যায়নি। ডুবতে ডুবতেও ডুবে যায়নি। দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর ফ্যাসিবাদ আমাদের জীবনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করলেও আমরা সমস্ত উদ্বেগের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতেও কিছুটা আরাম খুঁজে পেতাম। কারণ, আল মাহমুদ তখন আমাদের মধ্যে ছিলেন। তারপর স্বপ্ন দেখতাম ভাবের মতো চাঁদ, ঠান্ডা ও গোলগাল।
তিন.
বাংলা সাহিত্যে মীরদের প্রথম আবির্ভাব ১৮৪৭ সালে। মীর মোশাররফ হোসেনের মধ্য দিয়ে। প্রথম এবং অসাধারণ ছিলেন সেই মীর। ১৮৮৫ সালে যদি তার বহু বিখ্যাত ‘বিষাদ সিন্ধু’ না-ও প্রকম্পিত হতো, তাহলেও তাকে নিয়ে পরবর্তীতে আমরা যা যা করেছি তার ব্যত্যয় ঘটত না। যেকোনো বিচারেই তিনি ছিলেন আমাদের নবজাগরণের অগ্রদূত। এই মীরের জন্মের ৮৯ বছর পর ১৯৩৬ সালে দেশের আরেক প্রান্তে দ্বিতীয় মীরের জন্ম। এই মীর আল মাহমুদ।
প্রথম মীরের সঙ্গে দ্বিতীয় মীরের মিল ও অমিল অনেক। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘সোনালী কবিন’ কাব্যের পর আর যদি কিছু নাও লিখতেন, তাহলেও আল মাহমুদ আল মাহমুদই থাকতেন। দুই মীরের বাড়ি দুই নদীর তীরে। একজন গড়াই ক‚লের, অন্যজন তিতাস তীরের। একজনের বিষাদ সিন্ধু এবং অন্যজনের সোনালী কাবিন- সমান মাত্রা ও শব্দবন্ধের। ‘স’ ও ‘ব’ তাদের মধ্যে সাধারণ। তার অমিলটা দুই জায়গায়- একজন মীর লিখতেন নামের আগে, অন্যজন মীর উপাধি কখনোই ব্যবহার করেননি। গদ্য-পদ্যে দু’জনই সমান সচ্ছল। তবে একজন গদ্যের সমুদ্র, অন্যজন কবিতার তাজমহল।
কাজী আব্দুল ওদুদ অবশ্য এ দুই মীরকে নিয়ে ‘মীর পরিবার’ গল্প গ্রন্থ লেখেননি। তবুও আহমদ মীর, মোস্তফা মীর, আশরাফ মীর- তাঁরা ‘মীর’ নিয়েই বেড়ে উঠেছেন।
চার.
আসলেই মীর বর্জনকারী আল মাহমুদ আমাদের জসীমউদ্দীন, আমাদের নকশীকাঁথার মাঠ। আমাদের সোজনবাদিয়ার ঘাট। আমাদের বালুচর। তিনি আমাদের জীবনানন্দ। আমাদের মহাপৃথিবী। আমাদের সাতটি তারার তিমির। তিনি নজরুলের সকালবেলার পাখি। রবীন্দ্রনাথের প্রভাতসঙ্গীত। আমাদের পিপুল বনের ঝাঁজালো হাওয়া।
শাসক এবং তাদের সাংস্কৃতিক বরকন্দাজরা কী করল, কী বলল তাতে বাংলাদেশের মানুষের কিছুই যায় আসে না। যায় আসে না বলেই তিনি থাকবেন আমাদের জাগরণে, আমাদের স্বপ্নে, আমাদের আত্মার গহিন গহনে, আমাদের দেহে। আমাদের তেরশত নদীর বাঁকে বাঁকে তিনি থাকবেন পানকৌড়ি পাখির ছতরে। তিনি থাকবেন ওপাড়ার সুন্দরী রোজেনার সর্বঅঙ্গের ঢেউয়ে। মকতবের মেয়ে আয়শা আখতারের খোলা চুলে। তিনি থাকবেন আমাদের ইসবগুলের দানার মতো জলভরা চোখের মরমে। থাকবেন ফারাক্কা লাঞ্ছিত আমাদের শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশের চকচকে বালুতে।
আল মাহমুদ কালের কুটিল কটাক্ষ উপেক্ষা করে থাকবেন আমাদের সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে। পাহাড়পুরে। ষাটগম্বুজের মিনারে মিনারে। কান্তÍজীর মন্দিরের কারুকাজে। তিনি থাকবেন ভাষা আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধে। থাকবেন বিরামপুরে। বিলের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁকে। আমাদের প্রত্যাবর্তনের লজ্জায়। স্বপ্নের শানুদেশে।
আল মাহমুদ থাকবেন ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে, কোমল ধানের চারায়, নিমডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটিতে। তিনি থাকবেন ফাবি আইয়ে আলায়ে রাব্বি কুমা তুকাজজিবানে। থাকবেন আমাদের চিন্তায়, চেতনায়, সৃজনশীলতায়। সেখানে তাকে অসম্মান করে, অনাদর করে এমন সাধ্য কোনো শাসকের নেই।
পাঁচ.
আল মাহমুদ ছিলেন বলেই এখনো স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। আল মাহমুদ ছিলেন বলেই আমরা এখনো হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি। আল মাহমুদ ছিলেন বলেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মৌলিক মৃত্তিকা হয়ে ওঠেন। উঁচুতে তুলে ধরেছেন দেশের সম্মান ও মর্যাদা। আল মাহমুদ ছিলেন বলেই মুসা ইবরাহিম, এম এ মুহিত, নিশাত আর ওয়াসফিয়া এভারেস্টের ওপর পা রেখেছিলেন। আর সাকিব আল হাসান হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।
নোংরা, স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণ ও মূর্খ কিছু প্রাণিকে এখনো এ দেশের মানুষ যে কবি বলে সম্মান করে, সে তো শুধু এই কারণে, আল মাহমুদ আমাদের মধ্যে আছেন এবং ছিলেন।
ছয়.
কবি আল মাহমুদকে নিয়ে যে কথাগুলো লিখলাম, তা পড়ে অনেকের গা জ্বলে যাবে, শরীর চুলকাবে। আমাদের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর মতো যারা একটু বেশি কৌশলী, তারা বলবে আবেগের দোকানদারি করা হচ্ছে। অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণা করা হচ্ছে। তাদের প্রতি আমাদের সহানভূতি থাকবে। আমরা তাদের ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দেবো। তারপর বলব, তোমাদের জীবন হলো নর্দমার ভেতরে। হাজারীবাগের ট্যানারির পচা পানিতে হয় তোমাদের অবগাহন। তোমাদের জীবন দুর্নীতি নিয়ে। তোমাদের সকাল হয় দুর্নীতির মাধ্যমে। দিন কাটে দুর্নীতি করে। রাতে ঘুমাও দুর্নীতির বিছানায়। স্বপ্নও দেখো দুর্নীতি নিয়ে। আল মাহমুদের মতো মহান কবির কবিতা তোমাদের মতো লোকদের বিষয় নয়, তার সত্য, সৌন্দর্যের চাবুক তোমাদের জোড়াতালির দেহে সইবে না। ‘সুসংবদ্ধ কথামালা’ নিয়ে স্বপ্নের সওদাগরী যারা করে, তাদের ভাষা বোঝার জন্য শিক্ষিত ও স্নিগ্ধ হৃৎপিন্ড তোমাদের নেই।
সাত.
২০১২ সালের ৮ জুলাই, আল মাহমুদের ৭৬তম জন্মদিনকে সামনে নিয়ে একটা রচনা লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল- ‘যদি আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান।’ বলেছিলাম, জীবদ্দশায় আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পাবেন কি না জানি না। মরণোত্তর নোবেল দেয়ার বিধানও তো চালু হয়নি। যা হোক, পেলে ভালো। না পেলে না পাবেন। নোবেল পাওয়ার জন্য তো আর আল মাহমুদ কবিতা লেখেননি। এখন নোবেল পেলে আল মাহমুদের আর কী আসে যাবে। তবে আমাদের মধ্যে সাড়া পড়ে যাবে। না পেলেও ক্ষতি নেই। কারণ, ইতোমধ্যে বাংলাভাষীরা আল মাহমুদকে নিয়ে সাজিয়ে তুলেছে তাদের ঘর ও অন্তর।
তবে আমি বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে তিনি বিশ্ব কবিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বাংলাদেশ ও এশিয়ার সীমা তো তিনি ছাড়িয়েছেন সেই ১৯৭৩-এ সোনালী কাবিনের যুগেই। এখন দরকার বাদবাকি বিশ্বের কাছে তাঁকে পৌঁছানোর জন্য আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আল মাহমুদ নেবেন কেন? নেব আপনি, আমি, আমরা।’
‘তবে নোবেল পুরস্কার পাওয়াও এখন এক মহা বিড়ম্বনার ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের দেশে। নোবেল লরিয়েটদের জীবনকে অতিষ্ঠ করার ক্ষেত্রে বাংলাভাষাভাষীদের জুড়ি মেলা ভার। যেন নোবেল পাওয়াটা এক ধরনের ক্রিমিনাল অফেন্স। এ জন্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নোবেল লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পোহাতে হয়েছে দুর্ভাগ্যজনক জিল্লতি। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দিয়ে পুরস্কারের অপমান করেছেন- এমন কথা বলার লোক সেদিনের কলকাতায় অভাব ছিল না। যেমন ড. ইউনূসকে হেনস্তা ও গালাগাল করার ক্ষেত্রে আমাদের যদুমদু ও নৈমুদ্দিরা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বিশ্বকে।’
‘যা হোক, সম্ভাবনার শেষ নেই। সম্ভাবনার কথা বলার মধ্যেও কোনো দোষ নেই। তা ছাড়া সব ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য হবে, এমন কোনো কথাও নেই। তো যদি সৌভাগ্যক্রমে আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান, তাহলে কী হবে? এই কি হবেরও কোনো শেষ নেই। তার চেয়ে আমরা বরং আল মাহমুদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উত্তর প্রতিক্রিয়ার কিছু অগ্রিম বাক্যাবলি লিপিবদ্ধ করে রাখি। এসব কাল্পনিক প্রতিক্রিয়া সত্য হোক, তা আমি চাই না।’
পাঠক প্রতিক্রিয়া পেশ করার আগে বলে রাখি, কবি আল মাহমুদ আমাদের পুঞ্জীভ‚ত পাপের কারণে নোবেল পাননি। এই প্রিয় পৃথিবীতেও তিনি আর নেই। তব আফসোস, নোবেল না পাওয়ার পরও আল মাহমুদের সঙ্গে মৃত্যুপরবর্তী সময়ে যে আচরণ করা হয়েছে, তা এক কথায় অমার্জনীয়। এখন মনে হচ্ছে, নোবেল পেলে তার প্রতি কৃত অনাদর, অসমাদর আরো বেড়ে যেত।
আমার ‘যদি আল মাহমুদ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান’ লেখাটির মধ্যে অনেকের অনেক অনেক প্রতিক্রিয়া যুক্ত করেছিলাম। কিন্তু মামলার ভয়ে, প্রাণের মায়ায় সেসব আর উল্লেখ করার সাহস পেলাম না।
আট.
আল মাহমুদ নেই। তার ব্যথিত বিদায়ে কষ্টে কঁকিয়ে উঠেছে দেশের আত্মা। সাধারণ মানুষ আহত হয়েছেন, হয়েছেন ক্ষুব্ধ। যারা সত্যিকার অর্থে সাহিত্যনিষ্ঠ, যারা সাহিত্যিকে সাহিত্য দিয়েই বিচার করেন, তারা হয়েছেন হতবাক। হয়েছেন মহাবিরক্ত। তাদের কেউ কেউ হয়তো আমারই মোত স্মরণ করেছেন জর্জ অরওয়েলের এনিমেল ফার্ম উপন্যাসের কথা।
শুধু কবি আল মাহমুদ চলে গেছেন নির্বিকারভাবে। আমাদের সামান্যতা, ক্ষমতা তাকে আর কোনো দিন স্পর্শ করবে না। অবশ্য করতও না। কোনো দিন মহাকালের হাতে নিজেকে সমর্পণ করার আগে যাওয়ার সময় তার কণ্ঠে হয়তো শেষবারের মতো ধ্বনিত হয়েছিল তারই অবিস্মরণীয় কাব্যকীর্তি, বাংলা সাহিত্যের চিরকালের অক্ষয় সঞ্চয়, সোনালী কবিনেরই প্রথম কবিতাটি
(প্রকৃতি)
কতদূর এগোলো মানুষ।
কিন্তু আমি ঘোর লাগা বর্ষণের মাঝে
আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতোন গাঢ় মাটির নরমে
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে
ভাবলাম, এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষানী আমার।
বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায়
যে নারী উদাম করে তার সর্ব উর্বর আধার।
বর্ষণে ভিজছে মাঠ। যেন কার ভেজা হাতখানি
রয়েছে আমার পিঠে। আর আমি ইন্দ্রিয়ের সর্বানুভূতির চিহ্ন ক্ষয় করে ফেলে
দয়াপরবশ হয়ে রেখেছি আমার কালো দৃষ্টিকে সজাগ।
চতুর্দিকে খনার মন্ত্রের মতো টিপটিপ শব্দে সারাদিন
জলধারা ঝরে। জমির কিনার ঘেঁষে পলাতক মাছের পেছনে
জলডোরা সাপের চলন নিঃশব্দে দেখছি চেয়ে
বাহুতে আমার
আতংকে লাফিয়ে উঠছে সবুজ ফড়িং
বুঝিবা স্বপ্নের ঘোরে আইল বাঁধা জমিনের ছক
বৃষ্টির কুয়াশা লেগে অবিশ্বাস্য জাদুমন্ত্রবলে
অকস্মাৎ পাল্টে গেল। ত্রিকোণ আকারে যেন
ফাঁক হয়ে রয়েছে মৃন্ময়ী।
আর সে জ্যামিতি থেকে
ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক
আমার চেতনা জুড়ে খুঁটে খায় পরস্পরবিরোধী আহার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন