জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে সরকারি ঘরনার বুদ্ধিজীবী মহল যতই গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করছেন দেশ-বিদেশ থেকে ততই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। সরকার থেকে বার বারই বলা হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র বিগত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থ বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। পক্ষান্তরে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষায় প্রশাসনিক পদক্ষেপের আহবান জানিয়ে House of Foreign Affairs Committee এর ৬ জন সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওয়ের নিকট পত্র প্রেরণ করেছেন। যার বক্তব্য এরকম: ‘জনাব সেক্রেটারি, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নেতিবাচক গতিবিধি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ভুল পথে চলছে উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস। এটি দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটির গণতন্ত্রের জন্যে হুমকি বলেও মন্তব্য করেছে মার্কিন আইন পরিষদ। একই সঙ্গে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের হুমকির বিষয়ে নজর দিতে আহবান জানানো হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি। বিশেষ করে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ভোট জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান এলিয়ট এল এনজেলসহ ৬ জন প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি পেন্টাগন থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ৬ কংগ্রেসম্যান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সুরক্ষায় প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে আহবান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওয়ের কাছে একটি চিঠি দিলেছেন। তাতে বাংলাদেশে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জালিয়াতি, ভোট কারচুপি ও ভোটারদের ওপর নিষ্পেষণের কথা উল্লেখ করা হয়। এলিয়ট এল এনজেলের নিজের ওয়েবসাইটে ওই চিঠি এবং এ সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। এর শিরোনাম হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি কলস ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একশন টু প্রটেক্ট ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ। যার অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষায় প্রশাসনিক পদক্ষেপের আহবান জানিয়েছে হাউজ ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওয়ের কাছে যে ৬ জন প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয়েছে তাতে স্বাক্ষর করেছেন প্রতিনিধি পরিষদের হাউস কমিটি অন ফরেন অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান প্রতিনিধি এলিয়ট এল এনজেল। প্রতিনিধি মাইকেল টি ম্যাকল (টেক্সাসের রিপাবলিকান)। তিনি কমিটির র্যাংকিং মেম্বার। প্রতিনিধি ব্রাড শারমান (ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেট)।’
নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ৬ ফেব্রæয়ারির বক্তব্য অনুযায়ী, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ছিল একটি বিতর্কিত নির্বাচন। মাহবুব তালুকদারের কথা প্রতিয়মান হয়, এমন সব অসঙ্গত কথা বলে যাচ্ছেন, যাতে সাংবিধানিক পদের প্রতি গণমানুষের আস্থা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ কথা বলা শুরু করেছেন। একটি অনির্বাচিত সরকারকে চিন্তাবিদগণ দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে মনে করছেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়েছে। কথিত জন প্রতিনিধিদের চেয়ে আমলাদের বিশেষ করে পুলিশী ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলাতান্ত্রিক অব্যবস্থাপনা রীতিমতো জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের অনির্বাচিত বা ভোটবিহীন সরকার প্রতিষ্ঠায় বিদেশি মহলের প্রভাব রয়েছে। গোটা বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব বিশেষ করে ভারতীয় প্রভাব বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আচরণে ভারত বাংলাদেশকে তার তাবেদার রাষ্ট্র মনে করলেও জনগণ ভারতের এই ঔদ্ধত্যকে মেনে নেয় না।
বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত। মহান মুক্তি যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা অনস্বীকার্য বটে। কিন্তু ভারত কার্যত একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি তার একটি এলার্জি আছে। নিজের সাফাই গাওয়ার জন্য ভারত প্রতিনিয়তই বলে থাকে যে, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু। কিন্তু বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মনে হয় যে, দেশটি বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বন্ধু। বাংলাদেশের অন্যান্য বৃহৎ রাজনৈতিক দল বন্ধু হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ১৯৭১ বা এর পূর্ববর্তী যে দলটির সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল সে দলের সাথেই ভারত বন্ধুত্ব কার্যকর রাখতে আগ্রহী। ভারতের সরকার পরিবর্তন হয়েছে বটে, তবে তার রাজনৈতিক গতিধারা বা আন্তর্জাতিক রিলেশনের নীতিমালা থেকে ভারত সরে আসেনি।
যে রাষ্ট্রের ভেটো পাওয়ার আছে মূলত তারাই জাতিসংঘের মালিক মোক্তার। জাতিসংঘ কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য ভেটো পাওয়ার সম্বলিত রাষ্ট্রগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। মিয়ানমারের গণহত্যার কথা সকলেই স্বীকার করে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠায়, কিন্তু তাদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির কোনো বক্তব্য নাই। ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশের ভ‚মি তার বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহার করছে, তাদের আরো দাবি রয়েছে। অন্যান্য দেশের দৃষ্টি থেকেও বাংলাদেশ মুক্ত নয়। ফলে কে কখন বাংলাদেশের বা বাংলাদেশের গণমানুষের অধিকার বাস্তবায়নের পক্ষে অবস্থান নেবে তা সহজেই অনুমান করা যায় না। রোহিঙ্গা সমস্যা বা অন্যান্য জাতীয় সমস্যার সমাধানের জন্য জাতীয় ঐক্যবদ্ধতার কোনো বিকল্প নাই।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন