প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিজমি, নদী ও খালবিল রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আইইইবি’র ৫৯তম কনভেনশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্থাপনা নির্মাণের সময় কৃষিজমি ও জলাধার যেন নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দেশে শিল্পায়ন যেন দ্রুত হয় সে জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার সময় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, কৃষিজমি যাতে নষ্ট না হয়, জলাধারের যেন ক্ষতি না হয়। নদী ও খালবিল বাঁচাতে হবে। এতে পরিবেশ সুন্দর থাকে।’ প্রধানমন্ত্রী, বলা বাহুল্য, এর আগেও বিভিন্ন উপলক্ষে কৃষিজমি রক্ষা, জলাধার সংরক্ষণ ও নদী-খাল বাঁচানোর তাকিদ দিয়েছেন। বাড়িঘর তৈরি, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি আবাদী জমিকে বাইরে রাখা এবং নদী, খালবিল বা জলাধারের কোনোরকম ক্ষতিসাধন না করার কথা বলেছেন। সবকিছু পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করার নিদের্শনা দিয়েছেন। বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না, পরিবেশের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কিছু করলে তার ফল কখনো ভালো হয় না। হিতে বিপরীত হয়, ক্ষতি হয়, বিপর্যয় ঘটে। কাজেই, যা কিছুই করা হোক না কেন, তা যেন পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করা হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই দিকটিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে তারা সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। তার সুফলও তারা ষোলআনাই ভোগ করছে। পক্ষান্তরে যেসব দেশে পরিবেশকে বেতোয়াক্কা করে উন্নয়ন প্রয়াস বা কার্যক্রম চালানো হয়েছে, সেসব দেশ তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পায়নি বা পাচ্ছে না। আমাদের দেশে পরিবেশকে যথাস্থানে রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম কতটা পরিচালিত হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আছে বলেই পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কার্যক্রমের ওপর প্রধানমন্ত্রীকে বারবার গুরুত্ব আরোপ করতে হয়।
অত্যন্ত দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশে নতুন নতুন বাড়িঘর তৈরি, শিল্পায়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ বা সম্প্রসারণ ইত্যাদির জন্য বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি চলে যাচ্ছে। কৃষি বা আবাদী জমির পরিমাণ এমনিতেই কম, তার ওপর প্রতিবছর যদি এর একটা বড় অংশ বেহাত হয়ে যায় তবে ভবিষ্যতে খাদ্যেৎপাদনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অন্যদিকে আমরা দেখছি, আমাদের নদী, খালবিল, জলাধার নির্বিচারে দখল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে গড়ে উঠছে বাড়িঘর, দোকানপাট, হাটবাজার ও শিল্পকারখানা। দেশে এমন কোনো নদী, খালবিল, জলাশয় নেই সেখানে দখলদারদের কালো হাত পড়েনি। বলা যায়, নদী-জলাধার দখলের একটা উৎসব চলছে দেশজুড়ে। রাজধানীর আশপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ প্রভৃতি নদী যেভাবে দখলদারদের কবলে চলে গেছে, তা থেকেই আন্দাজ করা অন্যান্য নদীর অবস্থা কী। রাজধানীর খালগুলোর অধিকাংশেরই কোনো অস্তিত্ব নেই। অধিকাংশ জলাধার নেই হয়ে গেছে। এক সময় রাজধানীতে অসংখ্য পুকুর ছিল। এখন দু’চারটি ছাড়া নেই। এ অবস্থা কমবেশি দেশের সর্বত্রই লক্ষ্যণীয়। শুধু তাই নয়, দেশের সড়ক-মহাসড়ক ও রেললাইনের দু’পাশের জমিরও বেশির ভাগ দখলে চলে গেছে। নদী, খালবিল, জলাশয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সরকারি জমি যারা দখলে নিয়েছে অথবা এখনো দখল করছে তারা বিত্তবান, প্রভাবশালী এবং তাদের রাজনৈতিক খুঁটির জোরও রয়েছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া বা দখল উচ্ছেদ করা অসম্ভবপ্রায় হয়ে পড়েছে। নদী, খালবিল, জলাধারসহ সকল প্রকার জমির দখল উচ্ছেদ করার তাকিদ ও সিদ্ধান্ত থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। সম্প্রতি রাজধানীর ‘জানালা’ বলে অভিহিত বুড়িগঙ্গায় অবৈধ দখল উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়েছে। অনেক ভবন ও স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই খবর পাওয়া গেছে, উচ্ছদকৃত জায়গা ফের দখল হয়ে যাচ্ছে। এরকম অতীতেও দেখা গেছে এবং সকল উচ্ছেদের ক্ষেত্রেই এটা লক্ষ্য করা গেছে। বলা যায়, দখল উচ্ছেদ ও পুর্নদখলের একটা ইদুঁর-বিড়াল খেলা বরাবরই চলছে।
নদী, খালবিল জলাধার, অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী ও সিদ্ধান্ত যেমন কারো অজানা নেই, তেমনি এক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনার বিষয়েও কমবেশি সকলেই অবহিত। তারপরও এগুলো দখল মুক্ত করা কেন যাচ্ছে না, সেটাই প্রশ্ন। দখলদাররা কি সরকারের চেয়ে শক্তিশালী? এটাও খুব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে সরকারকে শূণ্য সহনশীলতা দেখাতে হবে। নদী, খালবিল জলাধারসহ সড়ক ও রেলের জমি উদ্ধার করতে হবে। এ জন্য যতটা কঠোরতা দেখানো প্রয়োজন, ততটাই দেখাতে হবে। কেবল দখল উচ্ছেদ বা জমি উদ্ধার নয়, উদ্ধাকৃত জমি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে কখনো পুনরায় তা দখল হয়ে না যায়। অত:পর প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আবাদী জমি বাঁচিয়ে, নদী, খালবিল, জলাধার সংরক্ষণ করেই স্থাপনা, বাড়িঘর, শিল্পকারখানা ও রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণ করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য যে কোনো মূল্যে সুরক্ষা করতে হবে। পরিবেশবান্ধব উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন। এই উন্নয়নই সর্বাধিক সুফল দিতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন