ফয়সাল আমীন : সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটজুড়ে ঘন ঘন বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। একই সাথে বজ্রপাতে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিলও। গত চার দিনে বজ্রপাতের ঘটনায় সিলেট বিভাগে অন্তত ১০ জন মারা গেছেন। তন্মধ্যে একদিনেই মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের! এর আগে গত মাসে তিন দিনে বজ্রপাতে সিলেটে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর গত এক মাসে সিলেটজুড়ে অন্তত ৩০ জন মানুষ মারা গেছেন বজ্রপাতে। বজ্রপাতে এই মৃত্যুর মিছিল দেখে আতঙ্কিত সাধারণ মানুষ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে আতঙ্কিত না হয়ে যতোটা সম্ভব নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিতে হবে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, বজ্রপাত হচ্ছে আবহাওয়া কেন্দ্রীয় দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক। বাংলাদেশে দুটি মৌসুমে বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ‘প্রাইমারি সামার’। এপ্রিল-মে মাসজুড়ে এ মৌসুমের বিস্তৃতি। এসময়ে ভার্টিক্যাল ক্লাউড বা সম্ভু মেঘ থাকে বলে ঘন ঘন কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাত হয়। এই ‘প্রাইমারি সামার’ মৌসুম এখন জলজ্যান্ত আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ মৌসুমে ধারাবাহিক বজ্রপাতের ঘটনা এক বিভীষীকার নাম হয়ে ওঠেছে সিলেট বিভাগের মানুষের কাছে। গত ৪ দিনে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনায় মানুষকে এখন ‘বজ্রপাত আতঙ্ক’ আরো বেশি করে ঘিরে ধরেছে। গত ১২ মে বজ্রপাতে সিলেটের হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে প্রতাপপুর গ্রামের হাবিব মিয়া (২৫) নামক এক যুবকের মৃত্যু হয়। হাওরে বোরো ধান কাটার সময় তিনি বজ্রপাতের কবলে পড়েন। গত ১৩ মে সিলেটের সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে বজ্রপাতে মারা যান দু’জন। জগন্নাথপুরের কলকলি ইউনিয়নের আমির উদ্দিন (৩) নামক এক কৃষক বাড়ির পাশে হাওরে কাজ করার সময় বজ্রপাতে মারা যান। এছাড়া উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের বাগময়না গ্রামে বাবার সাথে হাওরে গিয়ে আবদুস সামাদ (৯) নামক এক শিশুর মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। একইদিন, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বজ্রপাতে শামসুল ইসলাম নামক এক ব্যক্তি মারা যান।
এদিকে গত রোববার (১৫ মে) বজ্রপাতে শুধু সিলেট জেলাতেই ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে চার কিশোর, এক বৃদ্ধ এবং একজন মাদরাসা শিক্ষক রয়েছেন। রোববার সকালে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার রাউটি বিলে বজ্রপাতে তিন কিশোরের মৃত্যু হয়। ইমরান হোসেন (১৪), সেলিম উদ্দিন (১৫) ও হোসেন খান (১৫) নামক ওই তিন কিশোর মাছ ধরতে বিলে গিয়েছিল। একইদিন সকালে সিলেট সদর উপজেলার হাটখোলা ইউনিয়নের লাকুয়াপাড়া হাওরে রুবেল আহমদ (১৬) নামক আরেক কিশোরের মৃত্যু হয় বজ্রপাতে।
এদিকে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের কাটাউড়া গ্রামে ইনছান আলী (৫৫) নামক এক বৃদ্ধ বজ্রপাতে মারা যান। রোববার বিকেলে বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করার সময় বজ্রপাতে তিনি মারা যান। এছাড়াও রোববার বজ্রপাতে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের ছাতারগ্রামের বাসিন্দা মাওলানা মোহাম্মদ আলী মারা যান। তিনি স্থানীয় তাজুল উলুম জাতুগ্রাম মাদরাসার শিক্ষক। এর আগে গত মাসে, ১৬, ১৭ ও ১৮ এপ্রিল তারিখে বজ্রপাতে সিলেটে মারা যান ১১ জন। ১৬ এপ্রিল হবিগঞ্জে ৩ জন এবং মৌলভীবাজারে একজন মারা যান। ১৭ এপ্রিল সুনামগঞ্জে এক ব্যক্তি বজ্রপাতে মারা যান। এছাড়া ১৮ এপ্রিল হবিগঞ্জে ৩ জন এবং সিলেটের ২ জন মারা যান বজ্রপাতে। সিলেটজুড়ে বজ্রপাতে গত প্রায় এক মাসে অন্তত ৩০ জন মারা গেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন বজ্রপাতের বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এসব কারণে মেঘের মধ্যে তড়িত প্রবাহিতা বৃদ্ধি পায়। যে কারণে বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাওরাঞ্চলে অত্যধিক বজ্রপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ পরিবাহী অনেক উপাদান যেমন- গাছ, বাড়িঘর এসব থাকে। বজ্রপাতের সময় এসবের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহ ছড়িয়ে যাওয়ায় জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা কম হয়ে থাকে। তবে হাওর অঞ্চলে খোলা আকাশের নীচে বিদ্যুৎ পরিবাহী কোনো উপাদান থাকে না। ফলে বজ্রপাত সরাসরি মানুষকে আঘাত করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বজ্রপাতের সময় কোনো জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে। ইলেকট্রনিক উপাদানগুলো, যেমনÑফ্রিজ, মোবাইল ফোন, ডিশ লাইন প্রভৃতির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে। যেসব বাসা-বাড়ির ছাদে মোবাইল টাওয়ার আছে, সেগুলো যেন সুরক্ষিত ও নিরাপদ হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া বজ্রপাত প্রতিরোধী ‘বজ্র নিরোধক দন্ড’ বাসা-বাড়িতে রাখার পরামর্শ দেন আনোয়ারুল ইসলাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন