বর্ষীয়ান সাংবাদিক, কলামিস্ট, ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আর্টক্রিটিক ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সাদেক খান গত সোমবার বেলা ১২ টায় ঢাকার বারিধারাস্থ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তার তিরাশি বছরের কীর্তিময় জীবন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে সাদেক খান অগ্রসেনানীর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, কখনো প্রত্যক্ষ কর্মী ও সংগঠক হিসেবে, কখনো চিন্তাবিদ ও কলমযোদ্ধা হিসেবে। এদেশের মাটি ও মানুষের জীবনযুদ্ধের সার্থক রূপকার হিসেবে তিনি কখনো প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামীর ভূমিকায়, কখনো চলচ্চিত্রকার হিসেবে,স্ক্রিপ রাইটার হিসেবে এবং কলম সৈনিক হিসেবে নিজের জীবনের পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন। যেখানে এ দেশের শাসকশ্রেণী ও তার সহযোগীরা সর্বদা ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগাভাগিতে ব্যস্ত থাকে, তখন একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হয়েও তিনি গতানুগতিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা কর্মকা- থেকে সচেতনভাবে নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি জীবনের শেষ কয়েক দশক তিনি সাংবাদিক হিসেবে কোন পত্রিকা বা গণমাধ্যমে বেতনভোগী পেশাদার সাংবাদিকতা না করেও একজন স্বাধীন, সচেতন ফ্রি-ল্যান্সার কলামিস্ট ও টিভি টকার হিসেবে রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন।
একটি সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া সাদেক খানের কর্ম ও কীর্তির বহুমাত্রিকতা বিস্ময়কর। স্বল্প পরিসরের এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে তার জীবনের সব কীর্তি তুলে ধরা সম্ভব নয়। পাকিস্তান গণপরিষদের স্পীকার আব্দুল জব্বার খানের জ্যেষ্ঠপুত্র সাদেক খানের সহোদর ভাই-বোন সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল মানুষ। এদের মধ্যে আছেন, সাবেক মন্ত্রী, আমলা এবং প্রখ্যাত কবি মরহুম আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কূটনীতিক মরহুম এনায়েতুল্লাহ খান, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বর্তমান সরকারের বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সেলিমা রহমান এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ইংরেজী দৈনিক নিউএইজ’র প্রকাশক শহিদুল্লাহ খান বাদল। ভাষা আন্দোলনের সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সক্রিয় সদস্য হিসেবে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে ছাত্রজীবনে জেলখাটা থেকে শুরু করে সফল চলচ্চিত্রকার এজে কারদারের কালজয়ী সিনেমা ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য় অভিনয়শিল্পী হিসেবে এবং পরবর্তীতে ‘নদী ও নারী’ চলচ্চিত্রের সফল পরিচালক হিসেবে সাদেক খানের প্রগতিবাদী সৃজনশীল কর্মতৎপরতা সবার জন্য সৃষ্টিশীল প্রেরণার বিষয় হয়ে থাকবে। প্রথম জীবনে বাম ঘরানার রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অকুণ্ঠ সমর্থক হিসেবে নানা মাধ্যমে, নানাভাবে নিজের মত তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছেন। বৈরী রাজনৈতিক শক্তির সমালোচনা তাকে কখনো টলাতে পারেনি। লেখায়, টকশো’ ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের বক্তা হিসেবে তিনি সর্বদা দ্বিধাহীনভাবে এ দেশের গণমানুষের পক্ষে কথা বলে গেছেন। বিগত এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের সময়ও তিনি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন।
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা পালন করেই সাদেক খান থেমে থাকেননি। লাখো মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে এবং যে কোন আধিপত্যবাদী শক্তির কবল থেকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপদ রাখতে সাদেক খান সবর্দা আপসহীন ভূমিকা পালন করে গেছেন। বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। পরিস্থিতির উত্তরণে দেশের নাগরিক সমাজের অনেকেই যখন দ্বিধাগ্রস্ত ও আপসমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ তখনো নিজের মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের কথাগুলো সাহসের সাথে তুলে ধরতে বা উচ্চারণে সাদেক খান কখনো পিছপা হননি। কালের সাক্ষী, বহুমুখী প্রতিভাধর সাদেক খানের মৃত্যু দেশের সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। একুশে পদক প্রাপ্ত সাদেক খানের মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়েছে। সাদেক খানের মৃত্যুতে আমরা একজন অভিভাবকতুল্য আলোকিত মানুষকে হারালাম। তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। সাদেক খানের জীবনাদর্শ তার পরিবারের সদস্য, অনুরক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। আমরা মরহুম সাদেক খানের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন