শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভূমিকম্পের আশঙ্কা : মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আছে কি?

আবু সালেহ মোহাম্মদ সায়েম | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ স্থানে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ৪ দশমিক ১ মাত্রার এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল গাজীপুর। এর স্থায়ীত্ব ছিল ২ সেকেন্ড। ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আবহাওয়া অধিদফতরের মতে, গত ১ বছরে এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়েছে। এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের আভাস বহন করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা ভয়াবহ বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে। এটা অবশ্যই একটা উদ্বেগের বিষয়। পৃথিবী পৃষ্ঠের অংশবিশেষের হঠাৎ অবস্থান পরিবর্তন বা আন্দোলনকেই ভূমিকম্প বোঝায়। যদি বুঝা যায়, ঘরের কোনো জিনিস নড়ছে, সিলিং ফ্যান দোলকের ন্যায় ঝুলছে, ওয়াসরুমের বালতির পানি উপচে পড়ছে বা কাঁপছে, দেয়ালের ঘড়ি, টাঙানো ছবিগুলো নড়ছে, বুঝতে হবে ভূমিকম্প হচ্ছে। ভূমিকম্প বা ভূকম্পন মানেই হলো পৃথিবীর কেঁপে ওঠা। সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। যথা ১. ভূপৃষ্ঠজনিত ২. আগ্নেয়গিরিজনিত ৩. শিলাচ্যুতিজনিত।
১৯১২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আলফ্রের্ড ওয়েগনার পৃথিবীর মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এক সময় পৃথিবীর মহাদেশগুলো একত্রে ছিল যা কালক্রমে ধীরে ধীরে একে অপরের থেকে দূরে সরে গিয়েছে। ওয়েগনারের এই তত্ত¡কে বলা হয় কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট। এ তত্ত¡ মতে, পৃথিবীর উপরিতল কতগুলো অনমনীয় প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলোকে বলা হয় টেকটনিক প্লেট। একেকটি টেকটনিক প্লেট পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গলিত পদার্থের বাহিরের আবরণ যা একটি পাথরের স্তর। ভূ-স্তরে যা কিছু রয়েছে তা এই প্লেটগুলোর উপরে অবস্থিত। টেকটনিক প্লেটগুলো একে অপরের সাথে পাশাপাশি লেগে রয়েছে। এগুলো প্রায়ই নিজেদের মাঝে ধাক্কায় জড়িয়ে পড়ে। কখনও মৃদু, কখনও সজোরে। যেহেতু প্লেটগুলো শিলা দ্বারা গঠিত, তাই ধাক্কার ফলে তাদের মাঝে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের মাত্রা অধিক হলে এক ধরনের শক্তি নির্গত হয় যা ভূ-স্তরকে প্রকম্পিত করে।
পৃথিবীতে বছরে গড়ে কত ভূমিকম্প হয়, তা শুনলে আমরা আতঁকে উঠতে পারি। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরে লাখ লাখ ভূমিকম্প হয়। তবে এগুলোর অধিকাংশই মৃদু যেগুলো আমরা টের পাই না। এর অনেকগুলো হয়তো বোঝাই যায় না, কারণ খুব প্রত্যন্ত এলাকায় এসব হয় অথবা সেগুলোর মাত্রা থাকে খুবই কম। সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে- প্রচন্ড, মাঝারি ও মৃদু। আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ভূপৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী এবং ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে গভীর ভূমিকম্প বলে। পৃথিবীতে যতো ভূমিকম্প হয় তার অধিকাংশ (প্রায় ৯০ শতাংশই) হয় রিং অফ ফায়ার এলাকাজুড়ে। এই এলাকাটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।
ভূমিকম্প মাপা হয় দুইভাবে- তীব্রতা এবং প্রচন্ডতা বা ব্যাপকতা। ভূমিকম্পের মাত্রা মাপা হয় রিখটার স্কেলে। স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হওয়া মানে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা। ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলেই এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৫-৫.৯৯ মাঝারি, ৬-৬.৯৯ তীব্র ৭- ৭.৯৯ ভয়াবহ, ৮-এর ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ।
২০১৬ সালে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান মাত্রার বিচারে বিশ্বের শীর্ষ ১০ ভূমিকম্পের একটি তালিকা প্রকাশ করে। যথা: চিলি, ২২ মে ১৯৬০। এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে ৯.৫ মাত্রার এই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল চার হাজার ৪৮৫ মানুষ। আহত হয়েছিল ২০ লাখের বেশি। দক্ষিণাঞ্চলে এই শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল। এই ভূমিকম্পে পুয়ের্তো সাভেদ্রা নামে একটি সমুদ্রবন্দর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এই ভূমিকম্পের ফলে সাগরে সুনামির সৃষ্টি হয়। সুনামিতে সৃষ্ট ঢেউয়ের কবলে পড়ে ফিলিপাইন ও জাপানে মারা গিয়েছিল আরো ১৭০ জন। চিলিতে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ আবারো ভূমিকম্প হয়। এটি আঘাত হেনেছিলো চিলির কনসেপসিওন শহরে। রিখটার স্কেলে ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিলো ৮.৮। এর ফলে পৃথিবীর শক্ত উপরিভাগে ফাটল ধরে এবং শহরটি ১০ ফুট পশ্চিমে সরে যায়।
আলাস্কা, ২৪ মার্চ ১৯৬৪। মাত্রা ৯.২ এই ভূমিকম্পের ফলে ভয়ংকর ভূমিধসের সৃষ্টি হয়েছিল। এতে সাগরে সুনামির সৃষ্টি হয়। মৃতের সংখ্যা ছিল ১২৮ জন আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩১ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার।
এছাড়া অন্য ভূমিকম্পগুলো হলো: উত্তর সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে, ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ (মাত্রা ৯.১), রাশিয়ার কামচাটকায়, ৪ নভেম্বর ১৯৫২ (মাত্রা ৯), আরিকায়, পেরুতে (বর্তমান চিলি), ১৩ আগস্ট ১৮৬৮ (মাত্রা ৯), যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে, ২৬ জানুয়ারি ১৭০০ (মাত্রা ৯), ইকুয়েডরের উপকূলে, ১৩ জানুয়ারি ১৯০৬ (মাত্রা ৮.৮), পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে, ১ নভেম্বর ১৭৫৫ (মাত্রা ৮.৭), আসাম-তিব্বতে, ১৫ আগস্ট ১৯৫০ (মাত্রা ৮.৬)।
ভূমিকম্পের কারণে বেশ কিছু অসংগতি দেখা যেতে পারে। যেমন: ভূমিকম্পের কারণে দিনের দৈর্ঘ্য কমবেশি হতে পারে। জাপানের উত্তর-পূর্বে ২০০৯ সালের ১১ মার্চ একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে, যার মাত্রা ছিলো ৮.৯। এর ফলে পৃথিবীর ভরের বণ্টনের পরিবর্তন ঘটে এবং তার প্রভাবে পৃথিবী ঘুরতে থাকে সামান্য দ্রুত গতিতে আর তখন দিনের দৈর্ঘ্য কমে যায়। সেদিন দিন ১.৮ মাইক্রো সেকেন্ড ছোট ছিলো।
যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহর প্রত্যেক বছর গড়ে দুই ইঞ্চি করে লস অ্যাঞ্জেলসের দিকে সরে যাচ্ছে। শহরের এই অবস্থান পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে, সান অ্যানডেয়াস ফল্টের দুটো দিক ক্রমশ একটি অপরটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই গতিতে চলতে থাকলে এই দুটো শহর কয়েক লাখ বছর পর একত্রিত হয়ে পড়বে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমিকম্পের আগে পুকুর, খাল-বিল, হ্রদ, জলাশয়ের স্থির পানি থেকে দুর্গন্ধ আসতে পারে। এমনকি সেই পানি সামান্য উষ্ণও হতে পারে। প্লেট সরে যাওয়ার কারণে মাটির নিচ থেকে যে গ্যাস নির্গত হয় তার কারণে এটা হয়ে থাকে। এর ফলে ওই এলাকার বন্যপ্রাণীর আচরণেও পরিবর্তন ঘটতে পারে। ওপেন ইউনিভার্সিটির প্রাণী বিজ্ঞান বিভাগ বলছেন, ২০০৯ সালে ইটালিতে একটি ভূমিকম্পের সময় এক ধরনের ব্যাঙ সেখান থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলো এবং ফিরে এসেছিলো ভূমিকম্পের পরে। আরো বলা হয়েছে যে, এই ব্যাঙ পানির রাসায়নিক পরিবর্তন খুব দ্রুত শনাক্ত করতে পারে। ভূমিকম্পের ফলে যে শুধু ব্যাঙের আচরণেই পরিবর্তন ঘটে তা নয়, ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৪ সালে সুনামির আগে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন তারা অনেক পশুপাখিকে দেখেছেন উঁচু এলাকার দিকে ছুটে যেতে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট কম্পন পশুপাখিরা টের পেয়ে যায়।
ভূমিকম্পের পরেও পুকুরে কিম্বা সুইমিং পুলের পানিতে কখনো কখনো ঢেউ দেখা যেতে পারে। একে বলা হয় শ্যাস। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমিকম্প হয়তো শেষ হয়ে গেছে কিন্তু তারপরেও কযেক ঘণ্টা ধরে অভ্যন্তরীণ এই পানিতে তরঙ্গ অব্যাহত থাকতে পারে। ১৯৮৫ সালে মেক্সিকোতে একবার ভূমিকম্প হয়েছিলো, তখন মেক্সিকো থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিং পুলের পানি ছিটকে পড়তে পড়তে শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
ভূমিকম্পের কারণে যাতে বাড়িঘর ধসে না যায় সে বিষয়টি মাথায় রেখেই ইনকা আমলের স্থাপত্য ভবন ও জাপানি প্যাগোডা নির্মিত হয়েছিলো। ৫০০ বছর আগে ইনকার স্থাপত্য কর্মীরা যখন মাচু পিচু শহর নির্মাণ করে তারা বাড়িঘর নির্মাণের ব্যাপারে একটি আদিকালের জ্ঞান কাজে লাগিয়েছিলো যাতে ঘন ঘন ভূমিকম্পের হাত থেকে তাদের বাড়িঘর রক্ষা পায়।
নেপালে ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল আঘাত হানে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প। এতে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়। এতে হিমালয়ের উচ্চতা কমে যায়। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা কমে যায় এক ইঞ্চির মতো।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাই ভূমিকম্পের পূর্বে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। শক্ত মাটিতে ঘরবাড়ি বানাতে হবে, এর জন্য যথাযথ পাইলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিল্ডিং কোড সম্পূর্ণ অনুসরণ করে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হবে, বাড়িতে একাধিক দরজা রাখতে হবে, যেন যে কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি সবাই বের হতে পারে। বাড়ি নির্মাণের সময় এমএস রড ব্যবহার করা উচিত। ইটের বদলে আরসিসি কলাম ব্যবহার করতে হবে। এগুলো বাড়ির নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেবে। ভবনের কাঠামো- লোডের অনুপাত অনুসারে হওয়া উচিত। রেইনফোর্সমেন্ট ছাড়া ভার বহন করা ভবন ছয় তলার ওপরে করা যাবে না। উচ্চতা ও লোডের হিসাব অনুসারে ভবনের ভিত্তি দিতে হবে। নরম মাটিতে ভবন নির্মাণ না করাই শ্রেয়। যদি একান্তই করতে হয় তাহলে লক্ষ্য রাখতে হবে ভিত্তি যেন শক্ত মাটি পর্যন্ত হয়। এমএস রড ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়। শুধু দরজা-জানালার ওপর দিয়ে দেয়ালের আগাগোড়া লিন্টেল দেয়াই শ্রেয়। ভবনের নকশা এবং কলাম ও বিম ডিজাইনের সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন ভবনটি সিসমিক লোড ও উইন্ড লোডের জন্য সহনীয় হয়। কনক্রিট প্রস্তুত করার সময় খোয়া, সিমেন্ট, বালির উপযুক্ত অনুপাত বজায় রাখতে হবে। পাহাড়ি এলাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে আগেই মাটির বোরিং টেস্ট করে নিতে হবে। ভবনের পাশে পাহাড় বা পানি থাকলে মাটির সমান্তরাল লোড বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক।
বাড়ি নির্মাণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন পাশের বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকে, বাড়ির নিচতলায় অধিক পরিমাণে ফাঁকা রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতে ভূমিকম্পের সময় বাড়িটি ধসে পড়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়,বাড়ি নির্মাণের সময় বিদ্যুৎ লাইনের ব্যাপারে বিশেষ নিরাপত্তা অবলম্বন করা দরকার। ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, শুধু সচেতনতার মাধ্যমেই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা লাঘব করা সম্ভব। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্প প্রতিরোধক নকশা ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা এড়ানো সম্ভব।
অগ্নিকান্ডের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্বদা অগ্নিনির্বাপক বাহিনী সরকারিভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে, বাড়িতে একাধিক বালিশ, কুশন ও হেলমেট রাখা উচিত এবং সম্ভব হলে শক্ত কাঠের মজবুত টেবিল ও ডেস্ক রাখা দরকার যা ভূমিকম্পের সময় আত্মরক্ষার্থে ব্যবহৃত হতে পারে, সহজেই ভূমিকম্প অনুধাবনের জন্য ঘরের কোনো স্থানে পানিভর্তি বালতি রাখা যেতে পারে।
যদি বুঝা যায়, ভূমিকম্প হচ্ছে তাহলে দ্রুত বাড়ির সব বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ ও চুলার গ্যাস নিভিয়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে, ঘরে থাকা কুশন, হেলমেট মাথায় দিতে হবে, আতঙ্কিত হয়ে উপর থেকে লাফ না দিয়ে বসে থাকা বা সম্ভব হলে সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করতে হবে, স্টিলের আলমারি, শোকেস ইত্যাদি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে, ভূমিকম্পের সময় ঘরের জিনিসের মায়া না করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বাইরে চলে আসতে হবে।
ভূমিকম্পের পর আমাদের দায়িত্বটা আরো বেশি বেড়ে যায়। আহত মানুষ উদ্ধার করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। জীবিত বা আহত অন্যান্য প্রাণীকেও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। সুস্থ মানুষ যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে এগিয়ে আসবেন তাদের সঙ্গে উদ্ধারকারী অন্য সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় করতে হবে, অপেক্ষাকৃত কম দুর্গত এলাকায় শিশু ও আহতদের যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে নিতে হবে, অবস্থা গুরুতর হলে সাহায্যের জন্য প্রতিবেশীর কাছে আবেদন করা যেতে পারে, ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় যত দ্রুত সম্ভব বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে যত দ্রুত সম্ভব জীবিতদের কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছাতে হবে, দ্রুত শিশুখাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করতে হবে, মৃত ব্যক্তি বা প্রাণীর শব দ্রুত সৎকার করতে হবে। তা সম্ভব না হলে পচন শুরু হওয়ার আগেই মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে, যত দ্রুত সম্ভব যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যেতে পারে, মানুষকে ধৈর্য ধারণ করার জন্য মিডিয়ার মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব প্রচার করতে হবে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দুর্গত এলাকার বাইরে থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দুর্গত এলাকায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেখানে মানুষ সম্পূর্ণরূপে অসহায়। সর্বগ্রাসী ভূমিকম্পের পরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ভেঙে পড়া ভবনের নিচে চাপা পড়া মানুষ উদ্ধার করা। যার জন্য প্রয়োজন কতিপয় যন্ত্রপাতি যা সরকারের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুত থাকা জরুরি। যেমন: ক্রেন, বুলডোজার, ফর্ক লিফট, ট্রাক্টর, চেইনপুলি, পাওয়ার শোভেল ব্রেক ডাউন ভ্যান, প্রাইমওভার, মোবাইল জেনারেটর, হেভিজ্যাক, ওয়েটবল, পানিবাহী গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, হেলিকপ্টার। এছাড়া ছুরি, দা, কাঁচি, দড়ি, শাবল, খুরপি ইত্যাদি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয়ে অবস্থিত। ইরানের তেহরান শহরের পরেই ঢাকা শহরের অবস্থান। তাছাড়া মধুপুর ফল্টে ভূমিকম্প হওয়ার পর ১২৫ বছর পেরিয়ে গেছে, কাজেই ১শ’ বছরের ভূমিকম্পের সাইকেল অনুযায়ী ঢাকায় আরও একটি উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। আবার কেউ কেউ ভূমিকম্প সাইকেলের কথা মেনে না নিতে চাইলেও বাংলাদেশ যে একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেভাবে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ অন্যান্য শহরে অপরিকল্পিতভাবে বিল্ডিং কোড না মেনে ঘরবাড়ি তৈরি করা হচ্ছে তাতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও একটু অধিক সময় স্থায়ী হলে ঘটে যেতে পারে ধ্বংসলীলা। অথচ ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল। সুতরাং সরকারের উচিত হবে এখনই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মধ্যে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ও ভূমিকম্পের করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করতে হবে এবং ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোতে আগে থেকেই ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে রাখতে হবে এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে কীভাবে দ্রুত উদ্ধার কাজ পরিচালনা করা যেতে পারে।
লেখক: প্রভাষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন