ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার কারণে অস্বাভাবিক দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে রাজধানীর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এ গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রতি বছর ঢাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ২ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও প্রায় একই অবস্থা বিরাজমান। ঢাকা শহরে প্রায় ২ কোটি মানুষের জন্য সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে এখানকার নদীগুলো তেমন কাজে আসছেনা। সরবরাহকৃত পানির ৭০ শতাংশের বেশী উত্তোলন করতে হচ্ছে ভূ-গর্ভ থেকে। এর ফলে পানির প্রথম স্তর ইতিমধ্যেই প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। এখন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তর থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি তুলছে ঢাকা ওয়াসা। উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে গত চার দশকে শত শত নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠে কোথাও কোথাও বিশীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। এসব নদীর অসংখ্য শাখা নদী মরে যাওয়ার পর অবশিষ্ট নদীগুলোও নাব্যতা সংকটের গ-ি পেরিয়ে এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। একদিকে উজানের পানি প্রত্যাহারের কারণে নাব্যতার সংকট, অন্যদিকে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, শিল্পবর্জ্য ও রাসায়নিক দূষণের শিকার হয়ে অধিকাংশ নদীর পানি তার স্বাভাবিক গুণাগুণ হারাচ্ছে। বিশেষত, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো মারাত্মক দূষণের কবলে পড়ায় পানি সব ধরনের ব্যবহারিক উপযোগিতা হারিয়েছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীও এখন একই ধরনের দূষণ ও দখলের শিকার হচ্ছে।
নদ-নদী ও সুপেয় পানি জীবনের উৎস এবং সভ্যতার অপরিহার্য অনুষঙ্গ। পানির উৎসমুখ বন্ধ হলে বা বিষাক্ত হলে জীবন ও সভ্যতার বিলুপ্তি অনিবার্য হয়ে ওঠে। পানি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের দূষণের ফলে একদিকে যেমন জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়, অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সমাজ সভ্যতার জন্য ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ঘন ঘন মৃদুমাত্রার ভূ-কম্পন হতে দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক পরিবর্তন এবং বজ্রপাতে ব্যাপক হারে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে মানুষ। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকাতেই তাৎক্ষণিকভাবে ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং ১ লাখ ৩১ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ঢাকায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আয়োজিত ‘ভূমিকম্পের ঝুঁকিহ্রাসে করণীয় ও প্রস্তুতি’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এই আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন। ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শতাধিক বছর আগে ১৮৯৭ সালে ঢাকায় ৭ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে কয়েকশ’ মানুষ মারা যায়। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল এক লাখ এবং পাকাবাড়ি ছিল মাত্র ১০০টি। এখন সে মাত্রার ভূমিকম্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে তা; নিরূপণ করাও অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার সাথে সাথে মাটির স্তরগুলো ভেতর থেকে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে এবং কোথাও কোথাও মাটির স্তরও দেবে যাচ্ছে বলে জানা যায়। ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে নদ-নদী, জলাভূমি, বনভূমি ও পাহাড়গুলো একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা ব্যূহ হিসেবে কাজ করে থাকে। এসব প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যূহের যে কোনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের প্রতিটি নদ-নদী, জলাভূমি, বনভূমি এবং পাহাড় এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মানুষের হাতে বেপরোয়া দূষণ ও দখলবাজির শিকার। ইতিমধ্যে হাজার হাজার একর জলাভূমি ভরাট হয়ে গেছে, হাজার হাজার একর বনভূমির গাছ কেটে জমি দখল করা হয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের পরিবেশ ও জীবনাচারে এসব দূষণ ও দখলবাজির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমরা এখন ঢাকায় উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে হাজার হাজার বহুতল ভবন ধ্বংস ও লাখো মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছি। অন্যদিকে আমাদের উজানের প্রতিবেশী দেশ ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে অভিন্ন নদীগুলোর পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার আয়োজন চূড়ান্ত করছে। আমাদের সরকার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে যেমন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ, তেমনি দেশের নদ-নদী, জলাভূমি, বনভূমি এবং পাহাড়গুলোর দূষণ ও অবৈধ দখলদারের হাত থেকে রক্ষায়ও চরমভাবে ব্যর্থ। সুন্দরবনের অদ্বিতীয় প্রাকৃতিক বিশ্বঐতিহ্য রক্ষায় নিবিড় উদ্যোগ গ্রহণের বদলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের নামে সরকার নিজেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুন্দরবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দেশকে সমূহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে প্রথমেই শিল্পদূষণ ও দখলবাজির হাত থেকে সব নদ-নদী, বনভূমি ও জলাভূমিকে রক্ষা, পুনরুদ্ধারের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সারফেস ওয়াটারের ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ সারাদেশে সেচ ও সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক রিজার্ভার নির্মাণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন