ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারা সংশোধনী মামলার শুনানিতে আপিল বিভাগ বলেছেন, ইউনিফর্ম ছাড়া (সাদা পোশাকে) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেফতারের ঘটনা গুরুতর বিষয়। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির উল্লেখিত ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে ১৩ বছর আগে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শেষ শুনানিতে গত মঙ্গলবার আপিল বিভাগ একপর্যায়ে উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। ২৪ মে রায়ের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। এদিকে শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ে যেসব নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে, তা দেশের সামাজিক বাস্তবতায় সম্ভব নয়। দেশে আইএসের আদলে জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ নানা উগ্রবাদী গোষ্ঠী মুক্তমনাদের নৃশংসভাবে হত্যা করছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ না হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। শুনানির এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, পুলিশ যেভাবে অভিযোগপত্র তৈরি করে তার বেশিরভাগ গৎবাঁধা। এখানে তারা কোন ‘অ্যাপ্লিকেশন অব মাইন্ড’ প্রয়োগ করে না। পুলিশ ও রাষ্ট্রপক্ষ এত ভুল করে, এটাই আদালতের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাদা পোশাকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে উচ্চতর আদালতের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ১৯৯৮ সালের যে মামলার সূত্র ধরে হাইকোর্ট রায়টি দিয়েছিলেন সেখানে বলা হয়েছিল, ডিটেনশন দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কারণ জানতে হবে। ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের ভেতরে কাঁচ দিয়ে নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটআত্মীয় থাকতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। বলাবাহুল্য, দেশে অপরাধ আছে, থাকবে। তাই অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত সবারই কাম্য। নিঃসন্দেহে সারা দুনিয়াতেই অপরাধের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। তার অর্থ এই নয় যে, অপরাধ তদন্তকালীন সময়ে প্রাণসংহারের ঘটনা ঘটবে। অপরাধীরা নানা কৌশল গ্রহণ করছে এটা যেমন সত্য, তেমনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও তার চেয়ে অধিক কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা স্বাভাবিক। তবে সাদা পোশাকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের বিষয়টি কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার এ প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান তুলে ধরছে। পুলিশ প্রধানও এর আগে সাদা পোশাকে গ্রেফতারের বিরোধিতা করেছেন। বাস্তবত দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের অনেকেরই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তীতে অনেকের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে এই পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করেছে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন জাতির পিতার দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে কোন কারণ ছাড়াই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার হদিস পায়নি।
বলা বাহুল্য, এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার নজির ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত যে মন্তব্য করেছেন, তা বাস্তবতার আলোকেই করেছেন। সাদা পোশাকে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক কাউকে গ্রেফতারের ঘটনায় আপিল বিভাগ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইউনিফর্ম না পরে গ্রেফতারের ঘটনাকে ভয়াবহ বলে অভিহিত করেছেন। সাদা পোশাকে গ্রেফতারের বিষয় নিয়ে সচেতন মহলও বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে। আমরা মনে করি, উচ্চ আদালত যথার্থসময়ে যথাযথভাবেই বিষয়টি আমলে নিয়ে মন্তব্য করেছেন। প্রধান বিচারপতি সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন এটা কলোনিয়াল। বলার অপেক্ষা রাখে না, সাদা পোশাক পরে ও বিনাওয়ারেন্টে গ্রেফতারের সুযোগ অনেক অপরাধীও নিচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে মানুষকে অপহরণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এ ধরনের ঘটনায় কারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আর কারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বেশধারী তা সাধারণ মানুষের পক্ষে চিনতে পারা মুশকিল হয়ে পড়ে। আমরা মনে করি, কাউকে গ্রেফতার করতে হলে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উচিত হবে নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরে এবং যথাযথ গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে গ্রেফতার করা। তা নাহলে জনমন থেকে আতঙ্ক কোনভাবেই দূর করা যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন