উত্তর ঠাকুরগাঁও গ্রামের কৃষক জহরলাল রায় ঋণ নিয়ে আবাদ করত ফসল। এনজিও আর সার কীটনাশকের দোকানে ঋণের জালে জর্জরিত সে, এবার মিষ্টি কুমড়ার ফলন তুলে দুটি এনজিও থেকে নেয়া ৯০ হাজার টাকা আর স্থানীয় সার কীটনাশকের দোকানে ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করে ঋণ মুক্ত হবে সে। সেই স্বপ্নে দিন রাত গায়ে গতরতে হাড় ভাঙ্গা খাটুনি জহর লালের। এবার ২৫০ শতক জমিতে মিষ্টি কুমড়ার আগাম আবাদ করেছেন সে। আগাম কুমড়া বাজারে তুলে লাভও হবে মোটা অংকের। কিন্তু এক রাতেই সব স্বপ্ন পুড়লো তার। দুটি এনজিওতে ৯০ হাজার টাকা ঋণের বিপরীতে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় ২৩শ টাকা। কিন্তু স্বপ্নের ক্ষেত পুড়ে ছাই হওয়ায় গলার কাটা হয়ে দাঁড়ালো ঋণের বোঝা। ঋণ নিয়ে এবার জহর লাল মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করেছিল।
জহর লাল রায় জানায়, মিষ্টি কুমরার ক্ষেত এখন পুড়ে লাল হয়ে পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। গাছে ফুল এসেছে আর ২ সাপ্তাহ পর ফল আসতো। কিন্তু এখন গাছ শুকিয়ে ফুল নষ্ট হয়ে যাবে।
তার মতোই ওই গ্রামের প্রশান্ত কুমার রায় মাষ্টার্স শেষ করে চাকরীর পিছনে না ছুটে আম লিচুর বাগান গড়ে তোলেন। তার বাগানে ৫০টি লিচুর ও ১৫০টি আমের গাছ রয়েছে। কিন্তু ওই রাতেই তার বাগান পুড়ে যায়। গেল বার ওই বাগান থেকে দেড় লাখ টাকার আম-লিচু বিক্রি করেছিল। সে আশায় এবারও বুক বেঁধে ছিল প্রশান্ত। কিন্তু সে আশা গুড়ে বালি। প্রশান্ত রায়ের দাবি কোন্ড স্টোর থেকে রেব হওয়া গ্যাসে তার বাগানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুড়ে গেছে গাছে পাতা আর আম লিচুর মুকুল। এতে এ দফায় তাকে দেড় লাখ টাকারও বেশি ক্ষতি গুনতে হবে। শুধু জহর লাল ও প্রশান্তই নয়, তাদের মতো ওই গ্রামে ৭০জন কৃষকের ফসল ক্ষেত পুড়ে গেছে উত্তর ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থিত আমানত কোল্ডস্টোরেজ থেকে বের হওয়া গ্যাসে। সোমবার দিবাগত রাতে পাইট ফেটে গ্যাস বের হলে আশপাশের মিষ্টি কুমড়া, মরিচ, ভুট্টা, শিম, শষা, আম ও লিচুর বাগান পুড়ে যায়। মঙ্গলবার বিকালে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা একত্রিত হয়ে ক্ষতিপুরনের দাবিতে ওই কোল্ড স্টোরের গেলে তালা মেরে দেয়। আশ্বাস দেয় কোল্ড স্টোর মালিক। এতে চাষিরা ফিরে গেলেও বুধবার ওই এলাকায় আবারো প্রতিবাদে নামে কৃষকরা। তাদের দাবি ক্ষতিপুরন দিতে হবে। কিন্তু মালিক পক্ষ বলছে, গাছে পানি ছিটিয়ে গাছ বাঁচাতে হবে। এতে ফিরে আসবে গাছের প্রাণ। কিন্তু তা মানতে নারাজ ওই এলাকার কৃষকরা। ক্ষতিগ্রস্ত ভবেশ রায়ের দাবি, এখন গাছে ফুল এসেছে। ১৫ দিনের মধ্যেই আসতো ফল। বর্তমানের পোড়া গাছ পানি দিয়ে সচল করে ফল আসতে আরো দেরি হবে। শুধু তাই নয়, মরা গাছ জীবিত করলে সে গাছে ফলনও হবে অনেক কম। ভবেশ রায় আরো জানায়, এবার তিনি মরিচের আবাদ করেছেন ১১০ শতক জমিতে। তাতে তার খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। গত মৌসুমে ওই জমি থেকে মরিচ বিক্রি করেছেন ১লাখ ৫০ হাজার টাকা। এবারও তার তেমনই লাভের আশা ছিল। কিন্তু পুরো মরিচের পাতা পুড়ে গেছে। তার মতো মলিন চন্দ্রও মরিচের আবাদ করেছিল ১৫০ শতক জমিতে। এতে ওই কৃষকেও ক্ষতির অংক গুনতে হবে।
ঘটনার পর বুধবার দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত পরিদর্শনে যান আমানত কোল্ডস্টোরেজের মালিক মোঃ আব্দুল্লাহ ও রমজান আলী। এ ব্যাপারে কথা বললে তিনি ইনকিলাবকে জানান, ঘটনাটি অনাকাঙ্খিত আসলে মেশিনারী জিনিস তাই কখন কি হয় বলা যায়না। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এতে আমাদের নিজেদেরও খারাপ লাগছে। আমরা চেষ্টা করছি গাছগুলো বাঁচাতে। এর পরেও যদি ক্ষতি পুরন দিতে হয় তা দেয়া হবে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, ওই কোল্ড স্টোরেজ থেকে এ্যামোনিয়াম গ্যাস নির্গত হয়েছে। এ ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট এলাকার উপ-সহকারি কৃষি অফিসার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরি করেছে। সেই হিসাবে ৭০জন কৃষকের ৩৫ একর জমি নষ্ট হয়েছে । স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলা হয়েছে। ওই কোল্ড স্টোরেজের মালিককে কৃষকদের ফসলের ক্ষতিপুরন দিতে হবে। তা না হলে ওই মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন