পানির অপর নাম জীবন হলেও কেবল পানি থাকলেই জীবন বাঁচে না। জীবন বাঁচাতে হলে বিশুদ্ধ ও সুমিষ্ট পানি প্রয়োজন। গভীর সমুদ্রে আটকে যাওয়া মানুষ যখন দেখে তার চারপাশে অসীম জলরাশি, অথচ এক ফোটা পানিও পান করার উপযোগী নয়, তখন তার কাছে এই পানির কোন মূল্য নেই। তৃষ্ণার্ত হয়ে বা সমুদ্রের নোনা পানিতে ডুবে মরা ছাড়া তার কোনো গতি থাকে না। অর্থাৎ পানি থাকলেই হবে না, জীবন বাঁচাতে তা হতে হবে পানের উপযোগী ও বিশুদ্ধ। বাংলাদেশের সৌভাগ্য, প্রকৃতি তাকে অপার মিষ্টি ও সুপেয় পানি দান করেছে। বিশ্বে মিষ্টি পানির দেশের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। আয়তনের তুলনায় এত বৃহৎ মিষ্টি পানির উৎস বিশ্বে বিরল। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদÐ যে কৃষি তার মূল উৎস মিষ্টি পানি। পানিবিহীন ফসল বাংলাদেশে হয় না বললেই চলে। ফলে কৃষি খাত বাঁচিয়ে রাখতে মিষ্টি পানির কোনো বিকল্প নেই। এই পানি দিয়েই কৃষক চাষবাস করছে এবং জিডিপিতে কৃষিখাত থেকে শতকরা প্রায় ১৯ ভাগ জোগান আসছে। মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৪৫ ভাগই কৃষিখাতে নিয়োজিত। পানির উপর বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য ও কর্মসংস্থানের সিংহভাগ নির্ভর করছে।
অসংখ্য নদ-নদীবাহিত পলি দ্বারাই বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ একটি বৃহৎ ব-দ্বীপ। সুজলা-সুফলা বাংলাদেশকে এখনো সজীব রাখছে নদ-নদী। তবে নদ-নদীর দেশ বাংলাদেশ এখন শুকিয়ে মরুভূমি হতে চলেছে। এক সময়ে যে নদীতে প্রবল ¯্রােত ছিল সে নদী এখন মরাগাঙে পরিণত হয়েছে। ¯্রােতহীন নিশ্চল জলাভূমির মতো পড়ে আছে। এর কারণ সবারই জানা। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান যে ৫৭টি নদী রয়েছে তার ৫৪টিই ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আর এসব আন্তর্জাতিক নদীর পানি ভারত একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে পানিশূন্যতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক কোনো নিয়ম-কানুন না মেনে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। ভারত তার ইচ্ছামতো বাঁধ, সংযোগ খাল নির্মাণ করে পানি নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ভাটির দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রাপ্য বেশি। ভারত এসব আইন ও রীতি-নীতির কোনো তোয়াক্কা যে করছে না। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। পাঠকও জানেন। ভারতের এই বৈরি আচরণের বিপরীতে আমাদের করণীয় কি এবং কি করছি, এ নিয়েও পানি বিশেষজ্ঞরা বছরের পর বছর বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছেন। দুঃখের বিষয়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ যেমন নিতান্তই কম, তেমনি মানুষের মধ্যেও সচেতনতার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ পানি রয়েছে, সে পানিটুকুও যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধ রাখার ব্যাপারে চরম উদাসীনতা রয়েছে।
দুই.
কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছে, তেল নিয়ে বিংশ শতকে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। একবিংশ শতকে যুদ্ধ বাঁধবে পানি নিয়ে, যদি না এখন থেকে এই পানি সংরক্ষণ ও এর সুষ্ঠ’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা না যায়। পানিকে ‘নেক্সট অয়েল’ বা ভবিষ্যতের তেল হিসেবে আখ্যায়িত করে কেউ কেউ বলছেন, পানি দখলে রাখা নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। এখনই এর ইংগিত পাওয়া যাচ্ছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ওয়াটার পলিটিক্স বা হাইড্রো পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ সুস্পষ্ট। প্রত্যেক দেশেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পানি ব্যবহারের পরিমাণও বাড়ছে। এ তুলনায় পানির উৎস কমে যাচ্ছে এবং যে পানি রয়েছে তার ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০ বছরে প্রত্যেকের বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ হ্রাস পাবে। বর্তমানে সারা বিশ্বের শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না। তারা কমবিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করছে। এর ফলে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখ লোক মারা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর তথ্যানুসারে, বিশ্বে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ২০ লিটার বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পানির সংকটে এর পরিমাণ দিন দিন কমছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পানি সংরক্ষণ ও যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে না তোলায় মিষ্টি পানির তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে। এ অঞ্চলে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশেও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। এ সংকট দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, একসময় দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরাপদ পানি সরবরাহের সুবিধা পেলেও আর্সেনিক ও লবণাক্ততাসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়ায় বর্তমানে তা কমে ৮৮ শতাংশে নেমেছে। পানির অপরিকল্পিত ব্যবহার পানির গুণগত মান এবং নিরাপদ পানির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিভাগের পানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চিংড়ি চাষসহ বিভিন্ন অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাÐের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানিতে ম্যাংগানিজ ও আয়রনের উপস্থিতি পানির পরিমাণ ও গুণগত মান কমে যাওয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। কৃষিকাজে অতিরিক্ত পানি ব্যবহারের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ৭.৫ মিটারের নিচে নেমে গেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে রাজধানীর প্রায় দুই কোটি জনগোষ্ঠীর পানির প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে রাজধানীর অনেক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৭০ মিটার নেমে গেছে। রাজধানীতে পানিদূষণের কারণে বছরে ক্ষতি হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। একদিকে শিল্প-কারখানা বিপুল পরিমাণ পানি ব্যবহার করছে, অন্যদিকে অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য ফেলে নদ-নদীর পানি দূষণ করা হচ্ছে। রাজধানীর চারপাশের নদ-নদীগুলোর দিকে তাকালে যে কেউ তা বুঝতে পারবেন। অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭০০ নদী ও শাখা নদী, ৯৮ হাজার হেক্টর জলাধার এবং ২৪ হাজার কিলোমিটারেরও অধিক নদী-নালার একটি বিশাল অংশ শুকিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। মোটাদাগে বাংলাদেশে মিষ্টি পানির সার্বিক চিত্র এটি। এই চিত্র থেকে বোঝা যায়, যতটুকু মিষ্টি পানি রয়েছে, তার যথেচ্ছ ব্যবহার এবং দূষণের বিষয়ে আমরা কেউই সচেতন নই। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থারও এ ব্যাপারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আছে বলে মনে হয় না। মিষ্টি পানি যে কতটা প্রয়োজনীয়, এ বিষয়টি তারা যথাযথভাবে উপলব্ধি করছে না এবং জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন বন্যা ও বৃষ্টির দেশ বাংলাদেশে পানির অভাব কোনো দিনই হবে না। অথচ বিগত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি সংকট যে তীব্র আকার ধারণ করছে, তা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। বৃষ্টি মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে না, শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদীতে পানির অভাবে উত্তরাঞ্চলের বিরাট এলাকাজুড়ে মরুকরণ প্রক্রিয়া, নাব্যতা কমে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভূভাগে সাগরের নোনা পানি প্রবেশ করে লবণাক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতি বছরই মরুকরণ প্রক্রিয়া ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির এলাকা বাড়ছে। বিষয়টিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
তিন.
নদ-নদীগুলো দেশের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে রয়েছে। ভাঙ্গন ও বন্যার কবলে পড়ে যেমন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি নদ-নদীর মাধ্যমেই তাদের জীবন-জীবিকা, সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ে উঠে। বলা হয়, যে নদীর অববাহিকায় মানুষ বসবাস করে, সেখানের মানুষের জীবনযাপন ও সংস্কৃতিতে সে নদীর প্রভাব থাকে। এক সময় নদ-নদীর ভাঙ্গন ও বন্যাকে অভিশাপ মনে করা হতো। এখন আধুনিক যুগে মানুষের কাছে নদ-নদী আশীর্বাদ এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের দুঃখ কেবল তারাই বোঝে। এজন্য সাগর থেকে মরুর মাঝ দিয়ে খাল ও নদী সৃষ্টি করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে দ্বিধা করছে না। অথচ প্রকৃতগতভাবে বাংলাদেশ নদ-নদীর দেশ হলে এ নিয়ে আমাদের চরম উদাসীনতা রয়েছে। মিষ্টি পানির মর্ম আমরা অনুভব করছি না। প্রকৃতির অপার দান মিষ্টি পানি যে চিরদিন থাকবে না, তা বুঝতে পারছি না। ইতোমধ্যে তার আলামত আমরা দেখছি। বিভিন্ন নদ-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পলি পড়ে অসংখ্য নদ-নদী ভরাট হয়ে গিয়েছে। সেখান মানুষ চলাচল করছে। প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় দেশের বিভিন্ন জেলার নদ-নদী শুকিয়ে মরে যাওয়ার করুণ চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে। শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদী দখল করে বাড়ি-ঘর ও স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। এসব চিত্র দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে দেখা যায় না। নদ-নদী বাঁচানোর কার্যকর কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নদী খননের যে প্রকল্প রয়েছে, তা অর্থ লোপাটের প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। ড্রেজিং প্রজেক্ট-এ প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় ঠিকই, তবে এ অর্থের সিংহভাগই প্রজেক্ট সংশ্লিষ্ট একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের পকেটে চলে যাচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় শত শত কোটি টাকা পানিতে ভেসে যায় শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তার কোনো প্রতিকার নেই। বস্তায় বস্তায় টাকা চলে গেলেও নদীর বক্ষদেশ থেকে বস্তায় বস্তায় পলি উঠে না। বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের অপচয় ও অপকর্ম অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে শ্যামল বাংলার পরিবেশ-প্রতিবেশ, দিন দিন সজীবতা হারিয়ে ¤øান হয়ে পড়ছে।
ভারত কখনোই আমাদের সজীব থাকতে দেবে না, এটা এখন দিবালোকের মতো পরিস্কার। ন্যায্য পানি পেয়ে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন ও শস্যভান্ডারে পরিণত হোক, সেটা সে চাইছে না। সে চায় বাংলাদেশকে তার উপর নির্ভরশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত করতে। চাল, ডাল, লবন, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর বাজারে পরিণত করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হরণ করতে। এর মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে ৫৪টি নদ-নদীকে। নিজের ইচ্ছামতো বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করে দিচ্ছে। ভারতের এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখন সকলেরই জানা। যেহেতু ভারতের সাথে পানির ন্যায্য প্রাপ্তি নিয়ে কোনো সুরাহা হচ্ছে না, তাই আমাদের উচিত নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদের করা। এ ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। এজন্য বর্ষার পানি সংরক্ষণে একাধিক বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেয়া প্রয়োজন। সরকার বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা ভারতের আপত্তিতেই স্থগিত হয়ে আছে। এ প্রজেক্ট অদূর ভবিষ্যতে হবে কিনা সন্দেহ। অথচ এ ব্যারেজ নির্মিত হলে দেশের কত যে উপকার হতো তা কল্পনাও করা যায় না। ভারত তার ক্ষতি হওয়ার অজুহাতে প্রকল্পটিতে আপত্তি জানিয়েছে। আমাদের দেশে আমরা পানি সংরক্ষণ করব, এতেও ভারতের আপত্তি। ভারত আমাদেরকে পানির ন্যায্য হিস্যাও দেবে না, আবার আমাদের নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরও করতে দিচ্ছে না। আমাদের সরকারও কিছু বলছে না। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে! অন্যদিকে দেশের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকা নদ-নদী বাঁচানো ও এর নাব্য ধরে রাখার মতো প্রকল্পের ব্যাপারে খুব একটা উদ্যোগী ভূমিকাও নিচ্ছে না। ড্রেজিং প্রকল্পটি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হতো, তাহলে কিছুটা হলেও উপকার পাওয়া যেত। অথচ নদ-নদীর বিষয়টি যেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত, সেখানে এ খাতটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। উপলব্ধি করছে না, এই উপেক্ষার কি ভয়াবহ পরিণতি সামনে অপেক্ষা করছে।
চার.
সুপেয় বা মিষ্টি পানি আগামী বিশ্বে কতটা মূল্যবান হয়ে উঠবে, তা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। উন্নত বিশ্বে এক বোতল বিয়ারের চেয়ে এক বোতল পানির দাম অনেক বেশি। অনেকে পানির তেষ্টা বিয়ার দিয়ে মিটায়। পানির এই স্বল্পতার কারণে সেখানে বড় বড় প্রতিষ্ঠান বোতলজাত বিশুদ্ধ পানির ব্যবসা খুলে বসেছে। প্রতি বছর গড়ে ৩০ মিলিয়ন বোতলের পানি তারা বাজারজাত করছে। বিশুদ্ধ পানি এখন তাদের অন্যতম লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মিষ্টি পানির জন্য তারা এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। ভবিষ্যতে তাদের কাছে এশিয়া হবে মিষ্টি পানির সবচেয়ে বড় উৎস। বাংলাদেশেও প্রায় এক যুগের অধিক সময় ধরে বোতলজাত পানির ব্যবহার চলছে। দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে কোনোদিন বোতলের পানি কিনে খেতে হবে, তা মানুষ ঘূর্ণাক্ষরেও চিন্তা করেনি। এর কারণ, বিশুদ্ধ পানির সংকট। বিষয়টি যদি আমরা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারি, তবে আমাদের দেশ নেক্সট অয়েল-এর অন্যতম বৃহৎ উৎসে পরিণত হবে। সরকারসহ প্রত্যেকের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উপলব্ধি করে এ ব্যপারে সচেতন হওয়া বাঞ্চনীয়। তা নাহলে শহর ও গ্রামে পানি পানি করে যে হাহাকার শুরু হয়েছে, তা নিয়মিত হয়ে দাঁড়াবে। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণে নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধিতে সরকারকে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। ভারত ন্যায্য পানি দিচ্ছে না বলে আমাদের চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। সুনির্দিষ্টভাবে নদ-নদী বাঁচাও অভিযান চালু করা এখন সময়ের দাবী। এ অভিযানে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের যেসব নদ-নদী, খাল রয়েছে সেগুলো খননের মাধ্যমে নাব্য বৃদ্ধির কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। দেশের যে এক ষষ্ঠাংশ হাওর-বাওড়, বিল রয়েছে সেগুলো সংস্কার করে পানির আধারে পরিণত করার উদ্যোগ নিতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির উপর থেকে চাপ কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পানি দূষণ ও নদ-নদী দখল বন্ধ করতে হবে। শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নদ-নদীতে ফেলা নিষিদ্ধ এবং উৎপাদিত বিষাক্ত বর্জ্য পরিশোধন করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্য মালিকদের বাধ্য করতে হবে। এ কথা বলা হয়, ঢাকা অনেকটা ভূস্বর্গের মতো। স্বর্গের চারপাশ ও নিচ দিয়ে যেমন স্বচ্ছ পানির ধারা প্রবাহিত হয়, তেমনি এক সময় ঢাকা শহরের চারপাশ ও অভ্যন্তরে নদী ও খালের স্বচ্ছ ধারা প্রবাহিত হতো। পরিতাপের বিষয়, স্বর্গের আদল থাকা সত্তে¡ও এদিকে নজর না দেয়ায় এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঢাকা আজ বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসের অনুপযোগী শহরে পরিণত হয়েছে। নদীগুলো দখল-দূষণে মেরে ফেলা হচ্ছে। রাজধানীতে যে অর্ধশত খাল ছিল সেগুলো হারিয়ে গেছে। এই নদী-খালের নাব্য ধরে রেখে যদি সংরক্ষণ করা যেত, তবে ঢাকা হতো মিষ্টি পানির উপর ভাসমান বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক শহর।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন