একদিকে যমুনার ভাঙনে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ জমি-জিরাত ও ভিটেমাটি হারাচ্ছে। অন্যদিকে পদ্মা ও তিস্তার পর এবার যমুনা নদীও অস্তিত্বের সংকটে পড়তে শুরু করেছে। এক সময়ের প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় গত কয়েক দশকে বিশালাকৃতির চর জেগে এর মূল চ্যানেল শীর্ণকায় নালায় পরিণত হয়েছে। গতকাল ঢাকার একটি ইংরেজী দৈনিকে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন বন্দর থেকে বিভিন্ন পণ্য বোঝাই প্রায় ৫০টি কার্গো জাহাজ দেশের উত্তরাঞ্চলের উদ্দেশে যাত্রা করে। যমুনায় অস্বাভাবিক নাব্যতা হ্রাসের কারণে চলাচল করতে না পারায় এগুলো পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট ও আশপাশে আটকে আছে। যেখানে এসব কার্গো পরিবহনের জন্য ন্যূনতম ১০ থেকে ১২ ফুট গভীরতা থাকা প্রয়োজন, সেখানে এই নৌ-পথের উত্তরাংশে ৭-৮ ফুটের বেশী পানি না থাকায় জরুরী পণ্য বোঝাই মাঝারি আকারের কার্গো জাহাজগুলো চলতে পারছে না। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা থেকে দেশের উত্তরের ১৬টি জেলার জন্য সার-বীজ, জ্বালানি তেলসহ প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য পরিবহন করছে এসব কার্গো জাহাজ। কয়েকদিন ধরে আটকে থাকা এসব জাহাজ থেকে পণ্যসামগ্রী সময়মত খালাস করতে না পারলে চলতি বোরো আবাদে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। নাব্য সংকটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে বন্দরে পৌঁছতে না পারায় জরুরী সরবরাহ অব্যাহত রাখতে অপেক্ষাকৃত ছোট নৌযানে পণ্য আনলোড করতে হচ্ছে। এতে জ্বালানি, সারসহ কৃষিপণ্যের ব্যয় স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে বোরো চাষীরা ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় নাব্য সংকটের কারণে বোরোতে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের লোকসানের ধকল আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরী হচ্ছে।
হাজার বছর ধরে এদেশের কৃষি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতিতে জালের মত ছড়িয়ে থাকা নদীগুলো প্রধান অবলম্বন হিসেবে কাজ করছে। হিমালয়ের গাঙ্গোত্রি ও যমুনোত্রি হিমবাহ থেকে সৃষ্ট গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বাহিত পলিদ্বারা গঠিত বিশ্বের বৃহত্তম গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তার প্রবাহ নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। প্রতিবেশী ভারত উজানে বাঁধ দিয়ে ও যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহার করে এখন মূলত বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। একদিকে উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার, অন্যদিকে অপরিকল্পিত নদীশাসন এবং অপ্রতুল ড্রেজিং-এর কারণে প্রমত্তা যমুনা এখন অনেকটা ‘বৈশাখ মাসের হাঁটুজলে’র ছোটনদীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষত: যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর থেকে যমুনা সেতুর উজানে সিরাজগঞ্জ থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত ২৩০ কিলোমিটার নদীতে সহস্রাধিক ছোটবড় চর জেগেছে। আরো অসংখ্য ডুবোচর জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে বলে জানা যায়। যমুনার গুরুত্বপূর্ণ অংশে সেতু নির্মাণ এবং পশ্চিমপার্শ্বে বাঁধ, গ্রোয়েন নির্মাণ এবং অপরিকল্পিত নদী শাসনের কারণেই যমুনা দ্রুত নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এর প্রেক্ষাপটে নদীর প্রবাহ এবং নাব্যতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ড্রেজিংসহ নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও আভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। যমুনায় অস্বাভাবিক নাব্য সংকটের পেছনে অপরিকল্পিত বা লোক দেখানো ড্রেজিংকেও দায়ী করা যায়। ড্রেজিং-এর নামে বছরে শত শত কোটি টাকা খরচ করা হলেও অপসারিত বালি ও পলি একই স্থানে ডাম্পিং করার কারণে অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই তা পুনরায় ভরাট হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। এতে কেবল অর্থেরই অপচয় হচ্ছে, নদী তার নাব্য ফিরে পাচ্ছে না।
চার শতাধিক বছর আগে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা নগর সভ্যতা এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে যে সাংস্কৃতিক বন্ধন গড়ে তুলে তা’ এখন পতনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এখন মৃতপ্রায় আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আর ঢাকা নগরী ইতিমধ্যে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকার প্রথম সারিতে স্থান লাভ করেছে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা বুড়িগঙ্গা দূষণকারী শিল্প-কারখানাগুলোকে কোন পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থার অধীনে আনতে পারেনি। সাভারে চামড়াশিল্প নগরী স্থাপনের সব আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পরও গত দেড়দশকে হাজারিবাগ থেকে টেনারিশিল্প সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগে সফল হয়নি। একইভাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের লাইফলাইন কর্ণফুলী নদীও দূষণ-দখলের শিকার হয়েছে। ভারতের বাঁধ নির্মাণ, পানি প্রত্যাহার ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কবলে পড়ে পদ্মা-যমুনাসহ সমগ্র বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় দেশের বিশাল একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত চার দশকে এ বিষয়ে দেশে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠলেও সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগের কথা পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে এক প্রকার ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে এখনো কার্যকর কোন জোরালো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুসারে ভারত এ ধরনের একতরফা পানি প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিতে পারে না। এ বিষয়টি অনতিবিলম্বে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যেতে হবে। সেই সাথে তিস্তার পানিচুক্তি, গঙ্গাচুক্তি অনুসারে পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সকল পক্ষের সমন্বয়ে অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি নদ-নদীগুলোতে সুপরিকল্পিত ক্যাপিটাল ড্রেজিং, রিজার্ভার নির্মাণসহ নদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন