‘আমি কয়েক মিনিট পরে আসছি। আমার ডাকের জবাবে ১৫ বছরের ছেলে তার রুম থেকে চেঁচিয়ে বলল। আমি এক বন্ধুর সাথে এক্সবক্স খেলছি। ’
‘কে তোমার বন্ধু?’ জিজ্ঞেস করি।
‘স্কাজবল নামের একজন’, বলল সে।
‘স্কাজবল? এটা কী রকম নাম! তার আসল নাম কী?’ জিজ্ঞেস করি।
‘জানি না’, একটু বিরক্ত হয়েই বলে সে।
‘কোথা থেকে এসেছে সে?’ আবার জিজ্ঞেস করি।
‘বোধ হয় কানাডার কোনো জায়গা থেকে। না থাম, সে ফ্রান্সেরও হতে পারে। আসলে আমি জানি না। ওহ্, বাদ দাও তো, এটা কোনো বিষয়ই নয়, কারণ স্কাজবল এই মাত্র খেলা ছাড়ল, তার বদলে এসেছে এক রোবট।’
‘আহা!’ সহানুভূতি প্রকাশ করতে চাইলাম,‘ তোমার বন্ধুর বদলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট’?
‘এটা কোনো ব্যাপার না বাবা, সব সময়ই এ রকম হয়। খেলা চলতে থাকে।’
কোনো ব্যক্তি বা খেলার ব্যাপারে আমার ছেলের যে মনোভাব, এখনকার দিনে তাদের বেলায় তা আসলে স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা একজন আরেকজনকে ‘বন্ধু’ বলে উল্লেখ করে। কিন্তু আমার কাছে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক খুব হালকা মনে হয়। আমার কাছে কোনোভাবেই স্কাজবল ও আমার ছেলের বন্ধুত্বকে প্রকৃত বন্ধুত্ব বলে মনে হয় না। এটা আমার জন্য চিন্তার বিষয়।
আমি উদ্বিগ্ন যে ইন্টারনেট-পূর্ব যুগের, সামনা সামনি দেখাশোনা হওয়ার বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা ইন্টারনেট-উত্তর যুগের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে হারিয়ে যায় কীনা! আর আমি এ ভাবনায় একা নই। আমি বুঝতে পারছি না আমার ছেলের কাছে এ কথা ব্যাখ্যা করা দরকার কিনা যে রোবট কোনো ভিত্তি তৈরি করে না, কারণ সে নিজে কৃত্রিম।
মানব সভ্যতার ইতিহাস যতদূর জানা যায় তাতে দেখা যায় যে বন্ধুত্ব হচ্ছে একটি সুন্দর জীবনের অংশ। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো গ্রন্থ হচ্ছে গিলগামেশ মহাকাব্য যা প্রায় চার হাজার বছর আগে লেখা। এ মহাকাব্য হচ্ছে গিলগামেশ ও তার প্রিয় বন্ধু এনকিদুর মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের কাহিনী। তার আগে আর কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি। বাইবেলেও নাওমি ও রুথের গল্পে বন্ধুত্বের কথা আছে। তাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও নাওমির জন্য রুথের গভীর ভক্তি ও ভালবাসা ছিল অপরিসীম।
প্রতি বছর অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যায় মানুষ ডিজিটাল বিশ্বে জায়গা করে নিচ্ছে। টিনএজাররা দিনে গড়ে নয় ঘন্টা পর্যন্ত সময় অনলাইনে কাটাচ্ছে। আমার কলেজে আসা নতুন ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে বলেছে যে তারা আসলে দিনের ১২ ঘণ্টা স্ক্রিনে থাকে। তাদের সব হোম ওয়ার্ক এখন অনলাইনে হয়। ২০১৮ সালের এক পিউ রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ৯০ শতাংশই নিয়মিত ভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে।
আমেরিকান শিশুরোগ চিকিৎসা একাডেমি ২০১৬ সালের এক নীতি বিবরণীতে হুঁশিয়ারি দেয় যে অতিরিক্ত অনলাইন মিডিয়া ব্যবহারকারী শিশুরা সমস্যাপূর্ণ ইন্টারনেট ব্যবহারের ঝুঁকিতে এবং যারা খুব বেশি ভিডিও গেম ব্যবহার করে তারা ইন্টারনেট গেমিং ব্যাধির ঝুঁকির সম্মুখীন। এমনকি সিলিকন ভ্যালিও ডিজিটাল স্বপ্নরাজ্যের ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান ভাবে সন্দেহগ্রস্ত হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি পেশাজীবীদের ৩২ শতাংশই এখন বিশ্বাস করেন যে আগামী দশকগুলোতে ডিজিটাল লাইফ আমাদের মানসিক মঙ্গলের জন্য ক্ষতিকর হবে।
২০০৫ সালের দিকে অনেক মানুষ জানায় যে তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সংখ্যা তিন থেকে কমে দুইতে এসেছে। ২০০৬ সালের এক সমীক্ষা শেষে দেখা যায়, ২৫ শতাংশের কাছাকাছি উত্তরদাতা বলেছে যে তাদের এমন কেউ নেই যাকে তারা সত্যই বিশ্বাস করতে পারে। আরো সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে যে এই প্রবণতা স্থায়ী হচ্ছে, আর টিনএজারদের মধ্যে অন্তরঙ্গ বন্ধুর জায়গা নিচ্ছে ডিজিটাল দক্ষ বন্ধু।
বন্ধুর সাথে অন্তরঙ্গতা হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তরুণদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বলে দেখা যায় না। এ অন্তরঙ্গতার অভাব অনলাইনে বাড়ছে বলে দেখা যাচ্ছে। অনলাইন বন্ধুদের বিরাট নেটওয়ার্কের কারণে তরুণরা সামাজিকতা অনুভব করছে যাদের সাথে তাদের সাক্ষাত বিরল বা যাদের সাথে কখনোই দেখা হয় না। বিপুল সংখ্যক অডিয়েন্সের কাছ থেকে লাইকস বা ডিজিটাল গ্রুমিং-এর অন্যান্য ফর্ম লাভ তাদের বারবার স্বপ্রকাশের সত্যতাকে সমর্থন করে।
কিন্তু এই তরুণরা কী জানে যে তারা কি পাচ্ছে না? এটা কী কোনো বিষয়?
জাপানে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে প্রায় পাঁচ লাখ তরুণ ‘হিকিকমোরি’ বা নিঃসঙ্গ যার অর্থ তারা বাড়িতে বাস করে না। আর ব্রিটেনে একাকীত্ব এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে সরকার একাকীত্ব বিষয়ক মন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করেছে। এক নতুন জরিপ মোতাবেক, ৮৬ শতাংশ আমেরিকান ও ব্রিটিশ বিশ্বাস করে যে প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করছে।
বন্ধুত্ব বিষয়ক প্রাচীন দার্শনিক মন্তব্যের কিছু এসেছে অ্যারিস্টলের নিকট থেকে। তিনি তার ‘নিকোমেকিয়ান এথিকস’-এ বলেছেন যে আনন্দ ও উপযোগিতার বন্ধুত্ব সহজেই গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু সহজেই তা পরিত্যক্তও হতে পারে। কারণ এ ধরনের বন্ধন গভীরতাহীন। পক্ষান্তরে গভীর বন্ধুত্ব হচ্ছে সেটাই যখন কেউ তার বন্ধুর কল্যাণের প্রতি যত্মবান হয়। কোনো লাভের আশায় যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। এটাই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব।
আপনার মাত্র দু’জন বন্ধু থাকতে পারে। কারণ সে জন্য অনেক সময় দিতে হয়, কাজ করতে হয়, উদ্যোগ নিতে হয়। বন্ধুদের মধ্যে থাকে দুটি জীবনের স্বাভাবিক অন্তরঙ্গতা ও নিবিড়তা। বন্ধুকে বন্ধুর জন্য সময় দিতে হবে। বন্ধুদেরকে একে অপরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
ক্লাসমেট ও কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীরা বন্ধু হতে পারে যেমন হতে পারে খেলোয়াড় দলের ও সঙ্গীত গ্রুপের সদস্যরা। স্বামী বা স্ত্রীরা। ধর্মীয় বা সামরিক সহকর্মী এবং এ রকম অন্যরা। এ উদাহরণগুলো বলে যে পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য বন্ধুত্বের ৩টি বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে- অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। আনুগত্য ও মানসিকতা শেয়ার বা মানসিক সংযোগ।
ডিজিটাল পরিমন্ডলের ব্যাপারে কী? আমাদের অনলাইন বন্ধুরা সে স্কাজবল বা কখনো দেখা না হওয়া ফেসবুক ফ্রেন্ডই হোক, মানসিক সংযোগের চাহিদা পূরণ করে। কারণ, আমরা ব্যাপকভাবে যোগাযোগটা করি ভাষার মাধ্যমে এবং পরস্পরকে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, হতাশা, বিশ্বাস ও মনোজগতের অন্যান্য বিষয়গুলো সম্পর্কে জানাই।
আমরা অনলাইনে কোনো ব্যক্তির সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। কিন্তু মুখোমুখি পরিচয়ের অভিজ্ঞতার তুলনায় সে সব অভিজ্ঞতা হালকা। অনলাইন কর্মকান্ড যেমন সোস্যাল নেটওয়ার্কিং, গেমিং নিশ্চিতভাবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু সেসব কী হৃদয়ের বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে?
গভীর বন্ধুত্বের জন্য পারস্পরিক সাক্ষাত প্রয়োজন। কিন্তু বহু অনলাইন মিথস্ক্রিয়ায়ই কী তা সম্ভব? বন্ধুত্বের জন্য প্রয়োজন সাথে থাকা ও বন্ধুর জন্য ত্যাগ স্বীকার করা। কিন্তু অনলাইন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর কোনোটিই সম্ভব নয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ডিজিটাল জীবনে সব কিছু শেয়ার করা হচ্ছে একটা বিমূর্ত ব্যাপার। এখানে আমরা আসলে কেউ কাউকে স্পর্শ করতে, কেউ কারো গন্ধ অনুভব করতে, মুখের বা মেজাজের অভিব্যক্তি দেখতে ইত্যাদি বহু কিছুই পারি না। প্রকৃত বন্ধন হচ্ছে যত না মনস্ত্বাত্তিক তার চেয়ে অনেক বেশি শারীরিক। আর তা শারীরিক সংযোগ দাবি করে। প্রকৃত বন্ধুত্বের আবেগময় আলিঙ্গন বন্ধুর মস্তিষ্ক ও শরীরে অক্সিটোসিন ও এনডোমরফিন তৈরি করে এবং অন্য যে কারো সাথে সম্পর্কের চেয়ে তাদের সম্পর্ককে অধিক শক্তিশালী করে।
বন্ধুত্ব ও ডিজিটাল জীবন কেন্দ্রিক তিনটি সম্ভাবনা আছে। প্রথম, ডিজিটাল জীবনে বন্ধুত্বের অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্যগুলোর সবই ধারণ করে, সুতরাং উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এতে আমার সত্যিই সন্দেহ আছে। দ্বিতীয়, ডিজিটাল জীবন স্পন্দমান জীবনকে গ্রাস করে ফেলে যে কারণে মানুষ দৃষ্টান্তমূলক বিষয়গুলোতে নিয়োজিত হতে পারে না। যেমন খেলাধুলা, যৌথ শিল্প, অবাধ ছেলেবেলা ইত্যাদি। এভাবে ডিজিটাল জীবন সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে। সর্বশেষ, ডিজিটাল জীবন মিথ্যা বন্ধুত্ব তৈরি করে (কারণ তা শারীরিক সম্পর্কহীন)। অন্য কথায়, তরুণরা জানে না যে তাদের প্রকৃত বন্ধু নেই।
হতে পারে প্রযুক্তি সম্পর্কে আমাদের ভীতি অতিরঞ্জিত। আমার ছেলে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে আমেরিকার শিশুরা এখনো স্কুলে ব্যাপক পরিমাণ সামনাসামনি সামাজিক সময় পায়। সে বলে, লাঞ্চ ও অন্য অবসর মুহূর্তে আমরা ফোনে মাল্টিপ্লেয়ার গেমস খেলি, শিক্ষক ও মেয়েদের নিয়ে আলাপ করে। আমরা হোমওয়ার্কে পরস্পরকে সাহায্য করি। এ সময় এক অন্যের সাথে খুনসুটিও করি।
কী একজন ভালো বন্ধু তৈরি করে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, বন্ধুদের স্বার্থ এক হতে হবে। আর আমি পছন্দ করি যদি কেউ যদি মজার মানুষ হয়। তারাও ভালো ও অনুগত। তাদের সাথে নানা রকম দেয়া নেয়া হয়।
আমি মনে করি, অনলাইন সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগ অনিবার্য। আমরা আগে সমাজ জীবনে এ রকম জিনিস দেখিনি। তবে হতে পারে যে শিশুরা ঠিক। হতে পারে। (নিবন্ধকার স্টিফেন টি. আসমা দর্শনের অধ্যাপক।)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন