স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীসহ সারাদেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে গভীর ও অগভীর নলকূপ দ্বারা পানি উত্তোলনের ফলে এমনটা হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এ বিষয়ে এখনই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে সুপেয় পানি পাওয়া দুষ্কর হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছর ভূগর্ভের পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার করে নিচে নামছে। ভূ-গর্ভের পানির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে আগামী পাঁচ বছর পর আরও আশঙ্কাজনক হারে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। আর্সেনিকের পরিমাণও বাড়বে। তখন নানা ধরনের দুর্ঘটনারও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ওই গবেষণায়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এক গবেষণায় দেখা যায়, ষাটের দশকে ৫০ ফুট নিচ থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উঠানো যেত। কিন্তু এখন ১৫০ ফুট নিচ থেকে পানি তুলতে হয়। গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে, সাধারণত মাটির নিচ থেকে যে পানি উঠানো হয়, সেটি নদী, খালবিল ও মাটি থেকে তৈরি হওয়া। পানি উঠালে প্রাকৃতিকভাবেই আবার পানি চলে আসত। কিন্তু এখন আর ভূ-গর্ভে সেই পানি যায় না। এর কারণ সেচ ব্যবস্থা। বোরো মৌসুমে প্রতিবছর যে হারে পানি সেচের জন্য ভূ-গর্ভ থেকে তোলা হয়, সে পরিমাণ পানি মাটির নিচে যায় না। ফলে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যায়। এ কারণে অগভীর তো দূরের কথা, গভীর নলকূপ দিয়েও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যায় না।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় নদী-নালা, পুকুর বা জলাধারের পানি কৃষি আবাদ ও সুপেয় পানি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন ভূ-গর্ভস্থ পানিই একমাত্র ভরসা। সত্তরের দশকের আগে দেশের মানুষের কাছে সুপেয় পানির প্রধান উৎস ছিল ভূপৃষ্ঠ বা পুকুর, নদী-খাল, বৃষ্টি আর জমিয়ে রাখা পানি। সত্তরের দশকের শুরুতে কৃষিকাজের জন্য দেশে প্রথম ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। সেই যে শুরু এরপর আর থামানো যায়নি। এর মধ্যে দেশের উজানে পদ্মা ও তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪ টি নদীতে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির চাহিদা বেড়েছে। গত চার দশকে দেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে প্রায় শতভাগ। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। এখন সুপেয় ও চাষাবাদের জন্য চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পানিই মেটাতে হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ থেকে।
তিস্তা অববাহিকা নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে একসময় তিস্তা থেকে পানি নিয়ে চাষাবাদ হতো। আশির দশকে তিস্তা ব্যারেজ করে নদী থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে বা নালা তৈরি করে ক্ষেত-খামারে সেচ দেওয়া হতো। কিন্তু, ভারতের পানি আগ্রাসনের ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে তিস্তা এখন পানিশূন্য, মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে গভীর-অগভীর নলকূপে শ্যালো মেশিন দিয়ে কয়েক বছর ধরে বিকল্প ব্যবস্থায় সেচ কার্যক্রম চালাচ্ছে কৃষক। কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। ১০ বছর আগে যেখানে ৬০-৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত, সেখানে পানি পেতে হলে এখন ১০০ থেকে ১২০ ফুট গভীরে যেতে হচ্ছে। শুধু তিস্তা অববাহিকা নয়, বাংলাদেশের উজানে ভারত গঙ্গায় বাঁধ দেওয়ার কারণে বহু আগেই পদ্মা নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলো এখন ধূধূ বালুচরে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের সাবেক পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ড. এস আই খানের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ নলকূপ রয়েছে। এই নলকূপ থেকে সেচের জন্য, খাওয়ার জন্য ও শিল্পের জন্য পানি তোলা হয়ে থাকে। ফলে আমাদের পাতাল পানি বা গ্রাউন্ড ওয়াটারের লেভেল প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশে বৃষ্টির পরিমাণ দুই মিটার। তা থেকে ১ মিটার পানি রিচার্জ হয়। এ ছাড়া বর্ষার সময় নদীর কূল ছাপিয়ে পানি যখন ক্ষেত-খামার ও জলাভূমিতে ঢুকে যায়, সেখান থেকে বাকি চার মিটার পানি রিচার্জ হতো। কিন্তু বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে আমাদের পাতাল পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে গ্রাউন্ড পানির লেভেল প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে।
ঢাকা ওয়াসা এবং ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডবিøউএম) তথ্যমতে, ঢাকা শহর ও এর আশপাশের এলাকায় ৩০০ মিটারের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ জলাধারের তিনটি স্তর রয়েছে। ১. আপার ডুপিটিলা অ্যাক্যুইফার-১; এ জলাধারের পুরুত্ব গড়ে ৬৯ মিটার, ২. আপার ডুপিটিলা অ্যাক্যুইফার-২; এ জলাধারের পুরুত্ব গড়ে ৩২ মিটার, ৩. লোয়ার ডুপিটিলা অ্যাক্যুইফার-৩; যার পুরুত্ব ৯৩ মিটার। প্রথম স্তরের (ডুপিটিলা অ্যাক্যুইফার-১) পানি ৭০ মিটার নিচে নেমে গেছে। ফলে এ জলাধারের অর্ধেক শুষ্ক অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার পানির চাহিদা প্রধানত মেটানো হচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তর থেকে উত্তোলন করে।
এদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানিও এখন ক্রমশ অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ঢাকাসহ দেশের বড় কয়েকটি শহরের আশপাশের নদীতে শিল্প কল-কারখানার বর্জ্য পড়ে অতিমাত্রায় পানি দূষিত হচ্ছে। এ পানি যেমন পান করা ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে, তেমনি দূষিত এ পানি মাটির নিচে ঢুকে অগভীর পানির স্তরকেও দূষিত করে তুলছে।
রাজধানী ঢাকায় দৈনিক পানির দরকার হয় ২২০ থেকে ২৩০ কোটি লিটার। তবে গ্রীষ্ম মৌসুমে এ চাহিদা আরও বাড়ে। নগরবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে ফোটানো হলেও কিছু এলাকায় সরবরাহকৃত পানি থেকে দুর্গন্ধ যাচ্ছে না, তা পানযোগ্যও করা যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহকৃত পানির ১৫ শতাংশ আসে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা থেকে পানি এনে শোধন করে তা নগরবাসীর জন্য সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ দুই নদীর পানি এতটাই দূষিত যে, তা শোধন করেও পানযোগ্য করা যাচ্ছে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন