কুমিল্লায় একের পর এক পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে ভবন। সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে এভাবে পুকুর ভরাট করায় নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। এছাড়া পুকুরের অভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও। কুমিল্লা ফায়ার সার্ভিস ও মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৫০০ পুকুর ও জলাশয় ছিল। দ্রুত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আবাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনে বর্তমানে এ অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে।
অধিকাংশ পুকুরের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। একইভাবে কুমিল্লার নানা প্রান্তে থাকা পুকুরগুলো একের পর এক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আর এসব স্থানে বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে সিটি করপোরেশন কিংবা পৌরসভা।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানে খাল-বিলসহ কৃষিজমি ড্রেজারে তোলা বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। দিন দিন বেড়ে যাওয়া লোকের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ভরা হচ্ছে এসব খাল-বিলসহ ফসলি জমি। ফলে ৩ বছরে এ জেলায় ১ হাজার ২০০ বিঘা আবাদি জমি বসতবাড়ি ও মার্কেটে পরিণত হয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে কৃষিজমি। জেলার বিস্তীর্ণ কৃষিজমি, জমি-সংলগ্ন খাল ও পুকুর যথেচ্ছভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা চরম আকার ধারণ করে। ভোগান্তির শিকার হয় স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীর।
কৃষকের শত শত একর জমির ফসল, ঘরবাড়ি, মৎস্য প্রকল্প, রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর প্রতিবছর এলাকাবাসীকে গুনতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকার লোকসান। কুমিল্লার একাধিক স্থানে জমি ও খাল ভরাট করায় অনেক জায়গায় জমি ও সড়ক আর আলাদা করে বুঝার উপায় নেই এক সময়কার কোনটি খাল আর কোনটি জমি।
অবৈধ ড্রেজার মেশিনে ভরাটের মাধ্যমে জেলার সর্বশেষ ভরাট কার্যক্রম চালাচ্ছে কুমিল্লার মুরাদনগরে শতাব্দির প্রাচীন কাচারি খালটি। গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাচারি খালের অস্তিত্ব মুছে দিতে বেপরোয়া হয়ে মাটি ভরাট করে দখল কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন একটি ভূমি সিন্ডিকেট। এ সময় মাটি ভরাট কাজে নিয়োজিত এক ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে দেখে বলেন, ছবি তুলছেন কেন? এটা আমাদের মালিকানা জায়গা বলেই ভরাট করছি। এ অবস্থায় তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি পাশের বাড়ির দিকে চলে যান।
খালপাড়ের বাড়ির মালিক আলমগীর, স্বপনসহ কয়েকজন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের জন্মের পর থেকেই খালটি দেখে আসছি। এক সময় এ খাল দিয়ে গোমতী নদীতে নৌপথে যাতায়াত করা যেত। স্থানীয় আরো কয়েকজন বলেন, স¤প্রতি সোনাকান্দা গ্রামের মৃত মালু মিয়ার ছেলে জুলমত, মৃত লাল মিয়ার ছেলে বাচ্চু মিয়া ও তারু মিয়াসহ প্রায় ৮-৯ জনের একটি দখলদার চক্র শ্রীকাইল মৌজার ৬৬৩৬ দাগের খালটি ভরাট কাজ শুরু করেন। এ নিয়ে স্থানীয় কৃষক ও সচেতন মহলে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয়রা জানায়, শ্রীকাইল এলাকার ফসলি জমিগুলোর পানি চলাচলের একমাত্র খাল এটি। পানি চলাচলের এ খাল দখল হলে এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। খাল ভরাটের শুরুতে স্থানীয় কৃষক ও জমির মালিকরা প্রতিবাদ করে বাঁধা প্রদান করলেও তাদের কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী চক্র সরকারি খাল ভরাট কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শতাব্দীর প্রাচীন ‘কাচারি খাল’ নামে পরিচিত এই খালটি সোনাকান্দাসহ আশেপাশের গ্রামের কয়েকটি খালের সাথে এর সংযোগ রয়েছে। জানা যায়, উপজেলার আকাবপুর ইউনিয়ন থেকে শুরু হয়ে শ্রীকাইল ইউনিয়নের সোনাকান্দাসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের মেঠোপথ ধরে বয়ে গেছে শতাব্দির প্রাচীন কাচারী খালটি। এ খালের উপর নির্ভরশীল ওই এলাকার কয়েক হাজার কৃষক। বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন আর শুস্ক মৌসুমে পানি আহরণের এ খালটি এখন দখলের কবলে পড়েছে। একে একে এ খালটি দখল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে ভরাটের কারণে এলাকার কৃষিজমি কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন কুমিল্লা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক দিলীপ কুমার অধিকারী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ ২০০০ আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কোনো জলাধার, পুকুর, খাল, নদী, হালট, হাওর, বাওড়, নদী-নালা ভরাট করা যাবে না। যারা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে খাল দখলকারী অভিযুক্ত জুলমত মিয়া বলেন, খালের পাশে আমার জায়গা রয়েছে তাই জমি ভরাট করেছি। ভরাটের বিষয়টি স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে (তহশিলদার) অবগত করেছেন বলে তিনি জানান। তবে ইউনিয়ন ভ‚মি সহকারী কর্মকর্তা আজাদ হোসেন বলেন, যখন খালটি ভরাাট করা হয় এর এক মাস পূর্বে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে রিপোর্ট প্রদান করেছিলাম সেখান থেকে এখন পর্যন্ত কোন নির্দেশনা না পাওয়ায় দখলকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিতু মরিয়ম বলেন, খাল দখলের সাথে যারাই জড়িত থাকুক না কেন দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন