দেশের একমাত্র এবং এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় মা মাছের ডিম ছাড়ার ভরা মওসুমেও প্রত্যাশিত পরিমাণ ডিম পাচ্ছেনা জেলেরা। গত কয়েক বছর ধরেই হালদায় মাছের ডিমের এমন আকাল চলছে। সাধারণত বৈশাখ থেকে আষাঢ় (এপ্রিল-জুন) মাসের মধ্যে হালদা নদীতে মা মাছেরা ডিম ছাড়তে আসে। আর এ ডিম সংগ্রহ করে সারাদেশের মৎস্য হ্যাচারি ও মৎস্য চাষীদের কাছে সরবরাহ করা হালদার জেলেদের আয় রোজগারের একটি ঐতিহ্যবাহী উৎস। তবে মাছের ডিম ছাড়ার কিছু প্রাকৃতিক শর্ত রয়েছে। ডিম ছাড়ার মওসুমে মেঘলা আকাশ ও বজ্রসহ মুষলধারে বৃষ্টিপাতের মধ্যে ডিমওয়ালা মাছ ডিম ছাড়ে। এ ছাড়া স্রোতের তীব্রতা, পানির উষ্ণতাসহ সব ধরনের অনুকূল পরিবেশ এবং গর্ভজাত ডিম থেকে রেণু ছাড়ার পর তার টিকে থাকার সম্ভাব্যতা যাচাই করেই ডিম ছাড়ে মাছ। হালদার জেলেরা সেই শুভক্ষণের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষায় বসে থাকে। এসব হিসাব নিকাশে গত বৃহস্পতিবারও এমনি একটি সম্ভাব্য দিন ছিল। মেঘলা বৃষ্টিমেদুর দিনে শত শত জেলে হালদায় নৌকা নিয়ে মাছের ডিম সংগ্রহের অপেক্ষায় থাকলেও তাদের কারো ভাগ্যেই প্রত্যাশিত ডিমের দেখা মিলেনি। হালদা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মা মাছেরা প্রথম দফায় পরীক্ষামূলকভাবে স্বল্প পরিমাণ ডিম ছাড়ে। পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে অবশিষ্ট ডিমের দেখা মেলে। গত কয়েক বছর ধরে প্রথম দফার স্যাম্পল ডিম সংগ্রহ করেই হালদার জেলেদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
সুন্দরবনের মত হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটিও বাংলাদেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। নানা কারণেই এটি এক অনন্য বৈশিষ্ট্যম-িত মৎস্যচারণ ক্ষেত্র। শত শত বছর ধরে স্বকীয় ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকা এই প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি এখন পরিবেশগত সুরক্ষা ও ভারসাম্য হারাতে বসেছে। ১৯৪৫ সালে হালদার স্যাঙ্কচুয়ারি থেকে হাজার হাজার কেজি মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়। অথচ গত বছর নাকি হালদা থেকে মাছের ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪৭ কেজি। তবে এপ্রিলে খুব অপ্রতুল ডিম সংগ্রহের পর গত বৃহস্পতিবার মাছের ডিম সংগ্রহের পরিমাণ আশানুরূপ না হলেও আগের চেয়ে অনেক বেশী বলে জানা গেছে। দেশের শত শত নদ-নদী, হাওর ও খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের প্রাকৃতিক উৎস্য হ্রাস পাচ্ছে। শিল্পদূষণের শিকার হওয়ার কারণেও নদ-নদীগুলো মাছের বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে উপযোগিতা হারিয়েছে। পক্ষান্তরে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাছের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। এহেন বাস্তবতায় মৎস্যচাষী ও হ্যাচারির মাধ্যমে অধিক পরিমাণ মাছের রেণুপোনা সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরী। বিশেষত, রুই, কাতলা ও মৃগেল জাতীয় মাছের পোনা সংগ্রহের প্রাকৃতিক উৎস হালদা নদীতে ডিম প্রাপ্তি অস্বাভাবিক হ্রাস ও অনিশ্চিত হয়ে পড়া দেশের মৎস্য সম্পদ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হালদায় মাছের ডিম সংগ্রহ অনেক কমে যাওয়ার পেছনে নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। অবৈধভাবে বালি উত্তোলন, নদীর বাঁক কেটে স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন, শিল্প দূষণ, রাবার ড্যাম নির্মাণ, কৃষিজমির রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পানিতে মেশা এবং অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক শিল্পবর্জ্যরে দূষণে হালদা নদীর পানির প্রাকৃতিক গুণাগুণ নষ্ট হওয়ায় মা মাছের আগমন হ্রাস পাচ্ছে। সেই সাথে হালদায় যান্ত্রিক নৌযান চলাচল এবং এক শ্রেণীর জেলের ডিমওয়ালা মাছ শিকারকেও ডিম সংগ্রহ কমে যাওয়ার জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ বিগত শতকের সত্তুরের দশক পর্যন্ত দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মৎস্য চাষ হালদা থেকে সংগৃহীত রেণু পোনার উপর নির্ভরশীল ছিল। হালদা নদীতে মাছের প্রজনন হ্রাস পাওয়ায় গত কয়েক দশকে মৎস্যচাষীদের মূলত কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্রগুলোতে ইনব্রেডিংয়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এই কৃত্রিম প্রজনন ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত রেণু পোনায় মাছের উৎপাদন হ্রাস, বামনত্বসহ জিনগত সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণেই হালদার পোনার প্রতি মৎস্যচাষী ও হ্যাচারি মালিকদের আগ্রহ বেশী। এ দেশের মৎস্য সম্পদ এবং হাজার বছরের প্রাকৃতিক বিশ্বঐতিহ্য হালদা নদীর অদ্বিতীয় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষার মাধ্যমে মাছের ক্রমবর্ধমান চাহিদা নিশ্চিত রাখা অত্যন্ত জরুরী বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সামগ্রিক প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা হয়তো সম্ভব নয়। তবে রাসায়নিক দূষণ রোধ, নদী থেকে অবৈধ বালি উত্তোলন, সংরক্ষিত এলাকায় যান্ত্রিক ও বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধের পাশাপাশি ডিমওয়ালা মা মাছ শিকার বন্ধ করতে পারলে হালদার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষা করা হয়তো সম্ভব। হালদা নদীর চারপাশের কৃষি, শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম যাতে মা মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে এ নদীর অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যাহত করতে না পারে সে দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। চলতি মওসুমে মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আগামী দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে হালদায় প্রচুর মা মাছ ডিম ছাড়তে আসবে, সংশ্লিষ্ট সকলের এই প্রত্যাশা। হালদা নদীকে সারাদেশের অন্য সব নদ-নদীর পরিণতি থেকে রক্ষার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন