মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

বাঙ্গির গ্রাম ইলিয়টগঞ্জ

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, কুমিল্লা থেকে : | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

সবে আকাশে সূর্য উঠেছে। চারদিকে মানুষের ছুটোছুটি। সবার সেই একই ব্যস্ততা, জমি থেকে বাঙ্গি তুলে আনতে হবে। মৌসুমী ফল এটি। ইতিমধ্যে বিশাল চকের জমির মাঝখানে তৈরি খুপরীর মানুষগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। সারারাত বাঙ্গি পাহাড়া দিয়ে ঘুমঘুম ক্লান্ত দেহ তাদের। তবুও সবাই ব্যস্ত যে যার কাজে। গ্রামের ভিতর থেকেও দলে দলে আসছে লোক। সকাল ৭টা না বাজতেই নারী পুরুষ,ছেলে বুড়ো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাঙ্গি তোলায় মহাব্যস্ত। ১০ টার মধ্যে ফরিয়াদের হাতে বাঙ্গি তুলে দিতে না পারলে কপালে ভোগান্তি আছে তাদের। নির্ঘাত নির্ধারিত হাট ধরানো যাবে না। গাছ থেকে পাড়া বাঙ্গিগুলোও আর কিছুতেই ঘরে রাখা সম্ভব না, পঁচে সব সর্বনাশ হয়ে যাবে। এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোল ঘেঁষা কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ ইউনিয়নের টামটা গ্রামের ভোরবেলার চিত্র। এ গ্রামের কম-বেশি সবাই বাঙ্গি চাষের সঙ্গে জড়িত। এখানে দিন দিন বাঙ্গি বা ফুটি চাষ এতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে যে, এখন এ গাঁয়ে আর একটিও পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা অন্তত বাঙ্গি চাষ করে না।
এলাকায় জনশ্রæতি, শ’তিনেক বছর আগে এই বাঙ্গির বিজ এসেছিল সুদূর চীন থেকে। সেই থেকে আজও এখানে বাঙ্গির চাষ হচ্ছে। এ বিজ চীন থেকে এসেছিল বলে এখানকার অধিবাসীরা একে চীনাল আবার কেউ কেউ চীনা বাঙ্গিও বলে থাকেন। এর প্রকৃত মৌসুম মার্চ-মে বেলে-দোঁআশ মাটিতে বাঙ্গি বেশ ভাল ফলে। খুব অল্প সময়ের মৌসুমী ফল এটি। মৌসুমটা আসতে না আসতেই যেন চলে যায়। সময় স্বল্বতার কারণে কৃষকের ব্যস্ততাও অনেক। বছরে একবারই ফলে এই ফল। ডিসেম্বরের শুরুতেই এ চারা রোপন শুরু হয়। চলে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত। টানা তিন মাস ধরে কৃষকের সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। এর আবাদে খুব বেশি লাভ নেই, তবুও কৃষি প্রধান এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকার একটি বিরাট অংশ পূরণ হয় বাঙ্গি থেকে। আবাদ খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তা সামন্য জানালেন বাঙ্গি চাষি খলিল মিয়া। পাঁচ বিঘা জমিতে এবার তার বাঙ্গি ফলেছে। জমি তৈরি বিজ ও সার ক্রয়, চাষাবাদ খরচ সব মিলিয়ে তার ব্যয় হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে জমির অর্ধেকের বেশি বাঙ্গি বিক্রি হয়ে গেছে। এ বাবদ মোট পেয়েছেন ৩৯ হাজার টাকা। আরও ২০ হাজার টাকা তার হাতে আসার কথা। সেই ফজরের আযানের পর নামাজ পড়ে বেরিয়ে পড়েছেন জমিতে। ৪৭টি বাঙ্গি জমি থেকে তোলা হয়েছে তার। সকাল ৮টার মধ্যেই ফড়িয়া এসে তা নিয়ে গেছে। দাম মিলেছে ছোট বড় মিলিয়ে ৯ টাকা হারে ৪’শত ২০টাকা। সকালে ব্যস্ততা কেবল খলিল মিয়ারই নয়। এই গাঁয়ের অশীতিপর রহিম, আলী আযম, আসগর মিয়া এরা সবাই সেই ভোরে বাঙ্গি ক্ষেতে ছোটে এসেছেন। ছেলে বুড়ো সবাই ব্যস্ত বাঙ্গি তোলা আর বিক্রি নিয়ে। সকাল ৯টা বাজতেই সারি সারি দল বেধে মাথায় নিয়ে মহাসড়কের দিকে এগোতে থাকে সবাই। এখানে বাঙ্গি বোঝাই করার অপেক্ষায় আছে বহু ট্টাক। আছে ফড়িয়াও,তবে ফড়িয়াদের জ্বালায় অতিষ্ঠ এলাকার কৃষককুল। তাদের কথা লাভের ধন পিঁপড়াই খেয়ে যায়। এক একটা বাঙ্গি ১০/১২ টাকায় কিনলেও এ বাঙ্গি ঠিকই ফড়িয়ারা ২২/২৫ টাকা ধরে বিক্রি করছে। বাজারে এর খুচরা মূল্য আরও বেশি। এ ব্যাপারে ফড়িয়ারা জানালেন ভিন্ন কথা। রাস্তার খরচ,আর চাঁদা গুনতে গিয়ে তাদের খুব একটা লাভ থাকে না। বাঙ্গির বেপারী কুমিল্লার পাঁচকিন্দা এলাকার লিয়াকত আলীর মতে, পুলিশ আর মস্তানী ভাতা দিতে না হলে বাঙ্গি পিছু আরও ২/৪ টাকা দিলেও তাদের পুষিয়ে যেত। সকাল ১০টা বাজতেই সড়কে লাইন বেঁধে রাখা বাঙ্গিগুলো ট্টাকে উঠাতে ব্যস্ত হয়েছে একটি দল। আস্তে আস্তে কৃষকেরা ব্যস্ততা কমতে শুরু করে। ইলিয়টগঞ্জ গ্রামটি ছোট হলেও বির্স্তীণ জমি রয়েছে এই গ্রামে । মাঠের পর মাঠ জুড়ে বাঙ্গির চাষ করা হয়েছে। ইলিয়টগঞ্জে প্রতি মৌসুমে কি পরিমাণ বাঙ্গি হয় তার সঠিক হিসাব স্থানীয় কৃষি অফিস দিতে পারেনি। এলাকাবাসীর মতে প্রতি মৌসুমে প্রায় ৬ লাখ বাঙ্গি ফলে বলে ধারনা করা হয়। ইলিয়টগঞ্জের প্রায় ৫শ একর জমিতে কেবলই বাঙ্গির চাষ হয়। এই বাঙ্গির রয়েছে ঔষধি গুণ। বাঙ্গি শরীরের জ্বালা -পোড়া কমিয়ে দেয়, গরম শরীর ঠান্ডা রাখতে নাকি বাঙ্গির জুড়ি নেই। এছাড়া বাঙ্গি থেকে সুগন্ধী তৈরি করা সম্ভব। দেশে ব্যাপক আকারে বাঙ্গি চাষ করে এর জুস তৈরি করে ,তা বিদেশেও রপ্তানী করা যায়। বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় থাকলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেত এই বাঙ্গি দ্বারা।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন