বেপরোয়া দখলবাজির কবল থেকে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে উদ্ধার করতে না পারলে ঢাকা একটি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হতে পারে এমন আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। প্রায়শ গণমাধ্যমে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারনদীতে প্রভাবশালী মহলের দখলবাজির সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গৃহিত না হওয়ায় বেপরোয়া দখলবাজি বন্ধ হচ্ছে না। পুরনো দখলবাজদের পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুনদীতে নতুন নতুন দখলবাজের আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। হাইকোর্টের রুলিং ও নির্দেশনা অনুসারে নদীগুলোতে সীমানা পিলার স্থাপনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কৌশলগতভাবে দখলবাজদের পক্ষাবলম্বন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তা’ না হলে শত শত সীমানা পিলার ত্রুটিপূর্ণভাবে নদীসীমার ভেতরে স্থাপন করা অস্বাভাবিক বিষয়। নদীর সীমানা ঠিকমত চিহ্নিত করতে না পারলে, নদীর দখলকৃত ভূমি উদ্ধার ও দূষণ রোধের কার্যকর প্রক্রিয়া অনুসরণ করা সম্ভব নয়। ঢাকার পত্রিকাগুলো অনবরত রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোতে প্রকাশ্য দখলবাজির সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। এ বিষয়ে দেশের পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজের সাথে দখল ও দূষণ বিরোধী অভিন্ন জনমত গড়ে উঠেছে। সেই সাথে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা তো আছেই। সরকারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে দখলবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ও কঠোর অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। কথিত একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্সের কার্যক্রমও সক্রিয় রয়েছে বলে জানা যায়। তথাপি দখল ও দূষণের করাল গ্রাস থেকে নদীগুলোকে মুক্ত করা যাচ্ছে না কেন?
সর্ষের ভেতরে ভূত থাকলে তা দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় না। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগও বালু নদীতে দখলবাজির সাথে সরকারী দলের প্রভাবশালী নেতারা যেমন জড়িত, একইভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। যাদের জনস্বার্থে নদীরক্ষার দায়িত্ব পালন করার কথা, তারাই ব্যক্তি ও গোষ্ঠিগত স্বার্থে নদী দখলের মহোৎসবে শামিল হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি ও দখলবাজি বন্ধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকায় এরা সব সময়ই প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়া পাচ্ছে। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ঘটে, সরকারের পালাবদল ঘটে, কিন্তু বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীতে দখলবাজির চিত্র পাল্টায় না। পরিবেশবাদী, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের দাবীর মুখে মাঝে মাঝে লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয় বটে, তবে উচ্ছেদের ক’দিন পরই নতুন উদ্যমে কোন নতুন কুশীলব দখলবাজিতে যুক্ত হয়। বাংলাদেশে পরিবেশ বাঁচাও (বাপা) আন্দোলনের সভাপতি কথিত উচ্ছেদ অভিযানকে ‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা’ বলে অভিহিত করেছেন। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, কামরাঙ্গিরচর এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার একটি শাখা নদীর ২৪ হাজার ৫০০ কাঠা (প্রায় ৩৫০ একর) জমি দখল করে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। এসব দখলবাজির সাথে বিআইডাব্লিওটিএ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের উচ্ছেদ অভিযানে বুড়িগঙ্গার দুই পারে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কয়েকশ’ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও দখলদার এবং সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজশ অথবা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ছয় বছর আগে টাস্কফোর্সের উচ্ছেদ অভিযানের পর সংশ্লিষ্টরা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালুনদীর তীরঘেঁষা উচ্ছেদকৃত জমি সংরক্ষণ, ওয়াকওয়ে, পার্কিংইয়ার্ড ও সার্কুলার রোড তৈরীর কথা বলা হয়। পুনরায় দখল হয়ে যাওয়া জমি পুনরুদ্ধারের পরও একই বক্তব্য দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দখল, ভরাট ও দূষণের কবল থেকে নদীগুলোকে রক্ষার পাশাপাশি নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং সংযোগ চ্যানেলের মাধ্যমে যমুনা থেকে পানি এনে প্রবাহ বৃদ্ধি ও পানির গুণাগুণ বৃদ্ধির উদ্যোগের কথাও জোর দিয়ে বলা হয়েছে। এমনকি সার্কুলার নৌপথে যাত্রি ও পণ্য পরিবহনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও হয়েছে একাধিকবার। ঢাকার যানজট এড়িয়ে সদরঘাট থেকে আমিনবাজার, মিরপুর উত্তরাসহ ঢাকার উত্তরাংশের সাথে সম্ভাবনাময় এই যোগাযোগ নেটওয়ার্ককে সফল করতে সরকারী উদ্যোগ ছিল খুবই অপ্রতুল। সার্কুলার নৌপথ চালুর উদ্যোগটি যথাযথভাবে কার্যকর থাকলে তুরাগ নদীতে দখলবাজি অব্যাহত রাখা সম্ভব হতো না। নদী উদ্ধারে টাস্কফোর্সের উদ্ধার অভিযান মাঝে-মধ্যে দেখা গেলেও যে শত শত কল-কারখানা প্রতিদিন শত শত টন তরল ও কঠিন রাসায়নিক শিল্পবর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নদীর পাড়কে দখলমুক্ত করার চেয়ে নদীর পানিকে দূষণমুক্ত করা কম জরুরী নয়। হাজারিবাগের টেনারিশিল্প স্থানান্তরেও হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং চামড়া শিল্পের বিদেশী (ইউরোপীয়) ক্রেতাদের শর্ত উপেক্ষিত হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত দখল ও দূষণে বুড়িগঙ্গা শীর্ণ ও বিষাক্ত পানির নর্দমায় পরিণত হয়েছে। লোক দেখানো, দায়সারা ও কাগুজে অভিযান ও ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সরকার আবারো বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার নদীগুলোতে দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। সব শিল্প প্রতিষ্ঠানে যথাশীঘ্র ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে, অন্যথায় কারখানা বন্ধ করে দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। শুধু কথা দিয়ে হবে না, প্রতিশ্রুত কাজ করে প্রমাণ দেখাতে হবে যে সরকার দূষণ ও দখলমুক্ত নদী ও পরিবেশবান্ধব ঢাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে। দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে জনগণ সরকারের জিরো টলারেন্স দেখতে চায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন