আজ দিবাগত রাতই পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও রিজিক বৃদ্ধির উসিলা হিসেবে কিছু ফজিলতময় দিন ও রাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। পবিত্র লাইলাতুল বরাত তার অন্যতম। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে একে ‘লাইলাতুম মুবারাকাতুন’ বা বরকতময় রাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিস শরীফে রাতটিকে ‘লাইলাতুম মিন নিসফি শাবান’ বা মধ্য শাবানের রজনী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আজ সন্ধ্যা থেকে আগামীকাল সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত এই মহিমান্বিত রাতের পরিধি বিস্তৃত। ফারসী ভাষায় এ রাতকে শবেবরাত বা সৌভাগ্যরজনী বলে অভিহিত করা হয়। উপমহাদেশে এ নামই সমধিক পরিচিত। হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে, রজব ও রমজান মাসের মধ্যবর্তী শাবান মাসে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) অধিক সংখ্যক রোজা রাখতেন এবং মধ্য শাবানের দিবাগত রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রাত আসবে, তোমরা রাতে জাগ্রত থাকবে এবং পরদিন রোজা রাখবে। সূর্যাস্তের পর থেকে এই রাতে আল্লাহতায়ালা স্বীয় তাজাল্লিসহ নিকটবর্তী আসমানে অবস্থান করেন এবং বান্দাদের প্রতি এই আহ্বান জানাতে থাকেন: কোনো ক্ষমা প্রার্থী আছ কি, আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। আছে কি কেউ রিজিক প্রার্থী, আমি তাকে রিজিক দান করবো। আছে কি কেউ বিপদগ্রস্ত লোক, আমি তাকে বিপদমুক্ত করবো। ফজর ওয়াক্ত পর্যন্ত আল্লাহপাক এ আহ্বান জানাতে থাকেন।
এ রাতের মহিমা ও ফজিলত কত উচ্চ এ থেকেই তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। মহান আল্লাহর ক্ষমা, তার কাছ থেকে রিজিক, বিপদ থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য এ রজনী এক বিরাট সুযোগ এবং আল্লাহপাকই সে সুযোগ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাঁর বান্দাদের জন্য। এ রাতে নিবিষ্টচিত্তে তার দরবারে তওবা করা, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা, নফল নামাজ আদায় করা, দরূদ-শরীফ পাঠ করা, দান-খয়রাত করা, তসবিহ-তাহলিল করা, দোয়া-মোনাজাত করা, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা, কবর জেয়ারত করা এবং আল্লাহপাকের রেজামন্দি হাসিলের জন্য সারারাত ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকা বান্দার জন্য অপরিহার্য হিসেবে গণ্য। লাইলাতুল বরাতে আল্লাহর অসীম রহমত ও নৈকট্য লাভের এই সুযোগ থেকে খোদাভীরু বান্দারা নিজেদের বঞ্চিত রাখতে পারে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন: ‘যারা (অপরাধ করার পর অনুতপ্ত হয়) তওবা করে নিজেদের সংশোধন করে ও সত্য প্রকাশ করে আমি তাদের তওবা কবুল করি। আর আমি তওবা গ্রহণকারী ও করুণাময়।’ আরেক আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘হে রাসূল, আপনি আমার সব বান্দাকে বলুন, যারা নিজের ওপর নিজেরাই অপরাধ করে সীমা লংঘন করেছে, তারা যেন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়। নিশ্চয় আল্লাহ সব অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারেন।’ পবিত্র এই রাতে কয়েক শ্রেণীর মানুষ যেমন মুশরিক, গণক, যাদুকর, ঈর্ষাপরায়ণ, অন্যায়ভাবে হত্যাকারী, আত্মীয় সম্পর্ক ছেদনকারী, পরস্পর শত্রুতাপোষণকারী, জালিম শাসক ও তার সহযোগী, বাদক, মদ্যপ, ধর্ষণকারী, পিতা-মাতার অবাধ্যতাকারী ছাড়া সবাইকেই আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বরকতময় এ রাতে যারা ইবাদত-বন্দেগি করবে, তারা নিশ্চিতভাবেই সুফল লাভ করবে। ক্ষমা, বর্ধিত রিজিক এবং বিপদ-মুসিবত থেকে মুক্তি লাভ করবে। ইমাম সুবকি (রহ) তার তফসিরগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, জুমার রাতের ইবাদতের উসিলায় সারা সপ্তাহের গুনাহ মাফ হয়। লাইলাতুল বরাত নিয়ে আসে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানের আগমন বার্তা। রমজান মাসকে সামনে রেখে শাবান মাসে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের পালা শুরু হয়। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশে এমন এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ব্যবসায়ী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, রমজানকে অধিক মুনাফা লাভের উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা পবিত্র শাবান মাসেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াতে থাকে এবং রমজানজুড়ে তাদের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ইবাদত-বন্দেগির মাসকে উপলক্ষ করে এরকম মুনাফা শিকার দুর্ভাগ্যজনক। লাইলাতুল বরাতকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে সামাজিক আপ্যায়নের রেওয়াজ ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে এক শ্রেণীর শিশু-কিশোরকে এ রাতে হৈ-হুল্লা করতে ও পটকা ফুটাতে দেখা যায়। এটা সঙ্গত ও শোভন নয়। অভিভাবকদের উচিত শিশু-কিশোরদের এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখা। এটা ইবাদত-বন্দেগির রাত, আনন্দ-ফূর্তি ও হৈ-চৈ করার রাত নয়। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে একনিষ্ঠচিত্তে এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি করার এবং তার উসিলায় ক্ষমা, কল্যাণ ও বরকত লাভের তওফিক দান করুন। -আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন