শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রোয়ানুর তান্ডবে অপূরণীয় ক্ষতি

প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে দেশের উপক‚লীয় জনপদ লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সিডর ও আইলার পর এত তীব্রগতির ঘূর্ণিঝড় আর হয়নি। শনিবার দুপুরে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২৭ কিলোমিটার গতিতে রোয়ানু আঘাত হানে। বিকেলে এটি বাংলাদেশ অতিক্রম করে। সাধারণত সাগরের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেই ঘূর্ণিঝড়ের অনুক‚ল পরিস্থিতি তৈরি হয়। রোয়ানু সৃষ্টির আগে সাগরের তাপমাত্রা ছিল ৩০ থেকে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সঙ্গত কারণেই এর আঘাত তীব্র হয়েছে। সাগর থেকে ব্যাপক জলীয়বাষ্প গ্রহণ করে রোয়ানু আছড়ে পড়েছে উপক‚লে। ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপক‚লীয় এলাকা প্লাবিত করেছে। এর তান্ডবে উপক‚লীয় কয়েকটি জেলায় প্রাথমিক হিসাবে অন্তত ২৩ জন মারা গেছে। তারা মারা গেছে প্রধানত গাছ বা দেয়াল চাপা পড়ে, ইটের আঘাত, ট্রলারের চাপায় এবং জোয়ারের তোড়ে। সহস্রাধিক মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। এতে মৃত্যুর সংখ্যাও আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর পটুয়াখালী, হাতিয়া, কক্সবাজার প্রভৃতি এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। অতীতে ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন এলাকায়ও এবার আঘাত হেনেছে রোয়ানু। ক্ষতি হয়েছে অপরিমেয়। উপক‚লীয় এলাকায় ঘরবাড়ি, গাছপালা, শস্যক্ষেত, লবণের মাঠ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ইত্যাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিধি ও পরিমাণ আরো বেশি হতে পারত। বিশেষ করে প্রাণহানি আরো বেশি হতে পারত। হয়নি, তার কারণ, সরকার আগেই কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। ১৪ জেলার প্রায় ৫ লাখ লোককে প্রথম পর্যায়ে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। পরে সরিয়ে নেয়া হয় আরো তিন লাখ লোককে। স্থানীয় প্রশাসন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো মোটামুটি প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় সাফল্য, যার জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর অকুণ্ঠ ধন্যবাদ প্রাপ্য।
আশঙ্কার চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার পেছনে অন্যান্য ফ্যাক্টরও বেশ ভালো কাজ করেছে। রোয়ানু যখন বাংলাদেশ উপক‚লে আঘাত হানে তখন সাগরে ভাটার টান শুরু হয়। এতে ঝড়ের গতি ও জলোচ্ছাসের উচ্চতা কিছুটা কমে যায়। দ্বিতীয়ত, এবারও সুন্দরবন উপক‚লীয় সবুজ বেষ্টনী ও বেড়িবাঁধ রোয়ানুর অগ্রযাত্রা রুখে দিতে সামনে এসে দাঁড়ায়। বন-বাঁধের তাতে যথেষ্টই ক্ষতি হয়েছে। তবে উপক‚লীয় জনপদ অনেকটাই রক্ষা পেয়েছে। এর আগে সিডর-আইলার সময় সুন্দরবনের অবর্ণনীয় ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল। সুন্দরবন বাধা হয়ে না দাঁড়ালে মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো আরও অনেকগুণ বেশি। একথা সত্য, দুর্যোগ মোকাবিলা বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু তা যথেষ্ট ও সন্তোষজনক বলে মনে করার কারণ নেই। এখনো উপক‚লীয় জনপদে এক কোটিরও বেশি মানুষ অরক্ষিত-অনিরাপদ অবস্থায় রয়েছে। দুর্যোগকালে তাদের জরুরি আশ্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র আজও গড়ে তোলা হয়নি। ঝড়-জলোচ্ছােস প্রতিরোধ বেড়িবাঁধ গড়ে তোলার কাজও সম্পন্ন হয়নি। যা গড়ে তোলা হয়েছে তার অবস্থাও শোচনীয়। রক্ষণাবেক্ষণের অব্যবস্থায় এবার দেখা গেছে, বহু বেড়িবাঁধ ভেঙে সাগরের পানি সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। উপক‚ল জুড়ে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার কথা থাকলেও সর্বত্র সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়নি। যেখানে হয়েছে, সেখানেও তা কার্যকর অবস্থায় নেই। অনেক সবুজ বেষ্টনী ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। উপক‚ল এলাকায় রাস্তা নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলেও এখনো রাস্তা তৈরি হয়নি। সব মিলে বলা যায়, এখনো উপক‚লীয় জনগণ মারাত্মক অনিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে। উপক‚লীয় এলাকার সম্পদ-স্থাপনা, ফসল ইত্যাদি অরক্ষিত রয়েছে। সরকারের তরফে যদিও জোর গলায় বলা হয়, দুর্যোগ মোকাবিলায় ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এই দাবি যথেষ্ট সঙ্গতিশীল নয়।
উদ্বেগজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস মূল ভূখণ্ড আঘাত হানছে এবং বেশুমার ক্ষতি সাধন করছে। এবারও তা প্রত্যক্ষ করা গেছে। চট্টগ্রামে এবার যে ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো তুলনাই হয় না। রোয়ানু কেবল চট্টগ্রাম বন্দরেই আঘাত করেনি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ চর ও দ্বীপে আঘাত করেছে। জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে দিয়েছে। এমনকি চট্টগ্রাম মহা নগরের সওদাগরী পাড়া বলে খ্যাত চাকতাই-খাতুনগঞ্জও রেহাই পায়নি। এই বাণিজ্যিক এলাকার এমন কোনো গুদাম, আড়ৎ, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান নেই যা ডুবে যায়নি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কয়েক হাজার কোটি টাকার মালামাল ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া অসম্ভব। আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত ও অন্যান্য কারণে ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ্যস্থল মূল ভূখণ্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার বিষয়। এখনই বিষয়টি যথাযথ বিবেচনায় নেয়া দরকার। উপক‚লীয় জনপদ সুরক্ষা তো বটেই, সেইসঙ্গে মূল ভূখণ্ড রক্ষা করতে হবে। যে কোনো বিবেচনায় মূল ভূখণ্ডকে দুর্যোগ-বিপর্যয়ের কবলমুক্ত রাখার বিষয়টি অগ্রাধিকার দাবি করে। মনে রাখতে হবে, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এই শেষ নয়, সামনে এবং আগামীতে তা আরো ভয়ঙ্কর আকারে আপতিত হতে পারে। কাজেই, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা সঙ্গত কারণেই বলতে চাই, প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যূহ সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে, উপক‚লজুড়ে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে, উচ্চ ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে, উপক‚লীয় এলাকায় রাস্তাঘাটসহ উন্নত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে এবং অবশ্যই দুর্যোগ ও বিপদ থেকে উপক‚লীয় জনগণকে রক্ষা করতে পর্যাপ্তসংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন