এক ঘণ্টায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এক হাজার পরিবারের স্বপ্ন। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া আগুনে মালিবাগ কাঁচাবাজারের আড়াইশো দোকানের সবগুলোরই আলু-চাল-তেল-ডালসহ সব ধরনের মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ভয়াবহ এ আগুন থেকে রক্ষা পায়নি মাছবাজারের মাছ এমনকি জবাইয়ের জন্য রাখা বোবা ছাগলও।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা ২৭ মিনিটে আগুন লাগার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট ঘণ্টাব্যাপী চেষ্টা চালিয়ে ভোর ৬টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনের উৎস সম্পর্কে কারো কাছে কোন তথ্য নেই। তবে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ায় অনেক ব্যবসায়ীই আশংকা করছেন আগুন লাগার নেপথ্যে কোন কারণ রয়েছে।
ঘটনাস্থল ঘুরে ও ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২১ এপ্রিল শবে বরাত। এর ১৫ দিন পরই রমজান মাস শুরু। এই দুই উপলক্ষ ও সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারকে সামনে রেখে মালিবাগ রেলগেট কাঁচাবাজারের সব দোকানেই মজুত ছিল পর্যাপ্ত খাদ্যপণ্যের। কেউ দোকানের বাইরে বসে কাঁদছেন, কেউ পুড়ে যাওয়া মালামাল নিয়ে বসে আছেন, কেউ আবার পোড়া মালের ধ্বংসস্তুপ থেকে ভালো মালামাল খুঁজে বের করছেন।
মালিবাগ বাজার বণিক সমবায় সমিতি জানায়, আগুনে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৩২ মিনিটে যাত্রাবাড়ীর উত্তর কুতুবখালী এলাকায় একটি ভবনের গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগুনে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। তবে এতে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ব্যবসায়ী মালেক ও কামালসহ বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে একটি দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত। প্রথমদিকে স্থানীয়রা আগুন নেভাতে পানি দেওয়া শুরু করে। কিন্তু খুব দ্রুতই আগুন অন্যান্য দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন এত দ্রুত ছড়ায় যে মনে হয় এর মধ্য অন্য কোন রহস্য রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো বলেন, পরে খবর পেয়ে আধা ঘণ্টা মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের ১২ ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। আনুমানিক সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে কাঁচাবাজারের আগুন নেভানো হয়। এরই মধ্যে বাজারে ২৫০টি দোকান পুড়ে যায়। এতে নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যসহ মাছ-ছঅগলসহ কাঁচাবাজারের সবই পুড়ে গেছে।
মালিবাগ বাজার বণিক সমবায় সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নুরুল হক নুরু বলেন, প্রায় ২৬০ টি দোকানের মধ্যে একটি দোকানও অবশিষ্ট নেই। মাছ, মাংস, ডিম, ছাগল, চাল, টিন সবই পুড়ে গেছে। নগদ টাকাও পুড়েছে। অন্তত ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
মাংস ব্যবসায়ী রাসেল, সাইফুল ও রুবেল জানান, তাদের তিন দোকানে জবাই করার জন্য রাখা ৬৫ টি ছাগল ও তিনটি গরু জীবন্ত পুড়ে গেছে।
মাছের ব্যবসায়ী স্বপন বলেন, খবর পেয়ে এসে দেখি বাজারের পশ্চিম পাশের প্লাস্টিকের দোকান থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাজারে প্রায় আড়াইশ’ দোকান রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসলেও পানি সংকট ছিল। খবর পাওয়ার আধা ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিস এসেছে।
আগুনে পুড়ে যাওয়া দোকানের পাশে বড় ভাইকে জড়িয়ে কাঁদছেন গরম মসলা ব্যবসায়ী মালেক। তিনি জানান, শুক্রবার ও শবে বরাত উপলক্ষে তার দোকানে মাল বেশি ছিল। আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকার কম হবে না। আগুনে গরম মসলা তো পুড়ছেই, এছাড়া দোকানের সাটার, কাঠের তাক এবং ক্যাশবাক্সও পুড়ে গেছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছেন তিনি।
চাল ব্যবসায়ী মো. মামুন বলেন, আমার দোকানে ২৫ লাখ টাকার চাল ছিল। এর মধ্যে ৪০-৪৫ বস্তা চাল বাঁচাতে পেরেছি। এগুলোর অধিকাংশই আবার পানিতে ভিজে গেছে।
আমজাদ হোসেন নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, বুধ ও বৃহস্পতিবার বেশি মাল থাকে। কারণ শুক্রবার বেশিরভাগ মানুষ বাজার করে। বুধবার রাতে কুষ্টিয়া থেকে দেড় লাখ টাকার ১৮টি ছাগল এনেছিলাম। সকালে জবাই করার কথা ছিল। কিন্তু এসে দেখি সবগুলো পুড়ে গেছে। একদিনই আমার অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে গেল।
একসঙ্গে পুড়ল তিন ভাইয়ের স্বপ্ন
ছেলে-মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করবেন। এমন স্বপ্ন নিয়েই মালিবাগ কাঁচাবাজারে ফল ও বেকারির ব্যবসায় নেমেছিলেন তিন ভাই মো. আজিম, মো. মানিক ও মো. সুমন। সর্বনাশা আগুন পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে এই তিন ভাইয়ের স্বপ্ন। যে প্রতিষ্ঠান ঘিরে তারা নতুন নতুন স্বপ্ন বুনছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠান এখন শুধু ছাইয়ের অবশিষ্টমাত্র। আপেল, আঙুর, কমলা, বেদানা, বিস্কুট, চানাচুর-সব কিছুই পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হয়েছে। ২৫ লাখ টাকার পণ্যের মধ্যে এখন আর এক টাকাও অবশিষ্ট নেই। সব কিছু হারিয়ে তাদের মুখে এখন রাজ্যের হতাশা।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আগুনেপোড়া দোকানের মধ্যে চরম হতাশা মুখে বসে আছেন সুমন। দু’চোখ বেয়ে পানি না পড়লেও টলমল করছিল। আর নির্বাক তাকিয়ে দেখছিলেন লাখ লাখ টাকার পুড়ে যাওয়া পণ্য।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ভাই, আমাদের সব শেষ। দোকানে কিছুই অবশিষ্ট নেই। একটা ফলও নেই। সব কিছু হারিয়ে এখন তো পথে বসে গেলাম। ৩০ বছর আগে তার বড় ভাই মো. আজিম মালিবাগ কাঁচাবাজারে দোকান দেন। বড় ভাইয়ের হাত ধরেই পরবর্তীতে বছর পাঁচেক আগে তারা দুই ভাই ব্যবসায় নামেন।
মানিক বলেন, দুই দোকানেই মাল তুলেছি এক সপ্তাহ হয়নি। ফলের দোকানে ফল ছিল প্রায় ২০ লাখ টাকার। বেকারির দোকানে ১০ লাখ টাকার ওপরে পণ্য ছিল। এখন কিছু নেই।
আগুন লাগার তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে আগুন লাগার খবর পাই। সঙ্গে সঙ্গে এখানে ছুটে আসি। চোখের সামনেই সবকিছু পুড়ে ছাই হতে দেখেছি। কিছুই বাঁচাতে পারিনি।
যাত্রাবাড়ীতে গোডাউনের আগুন
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর উত্তর কুতুবখালী এলাকায় একটি ভবনের গোডাউনে বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৩২ মিনিটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
যাত্রাবাড়ী থানার এসআই কবির বলেন, উত্তর কুতুবখালীর বায়তুল মামুর জামে মসজিদের পাশের গলিতে একটি ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। এখানে টেলিভিশনের গোডাউন ছিল। ভবনের ৬ ও ৭ তলায় মাদরাসার শিক্ষার্থী থাকতো। কোনো হতাহতের সংবাদ পাইনি। তবে অনেকেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়।
এর আগে, গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে ঘটনাস্থলে ২৫ জন ও হাসপাতালে একজন নিহত হন। আহত হন আরও ৭৩ জন। এর দুইদিন পরই ৩০ মার্চ গুলশান-১ এর ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগে। আগুনে মার্কেটের কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে ৭২ জন নিহত হন। আহত হন অনেকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন